চঞ্চলতা, অতি চঞ্চলতা যখন রোগ

0
265

বিকাল তখন প্রায় শেষের দিকে। সিরিয়ালে ডাক পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে চেম্বারে এসে ঢুকল বছর সাতেকের ফুটফুটে ছেলেটা! তার মাকে ঢোকার সুযোগ না দিয়েই পড়িমরি করে ছুটে এসে বসলো রোগীর জন্য অপেক্ষমাণ চেয়ারে। প্রায় সাথে সাথেই হন্তদন্ত হয়ে যেন তাকে সামলাতে পিছু পিছু ছুটে এলো তার মা! কয়েক সেকেন্ড চেয়ারে বসার পর হুট করে হাত বাড়িয়ে কলমদানি থেকে তুলে নিল কলম; টেবিলের উপর একটা কিছু লিখতে যেয়ে আবার থেমে গেল সে! এইবার তার মনোযোগ কাড়ল টেবিলের উপর রাখা ভারী কাঁচের পেপার ওয়েট। চট করে তুলে ছুড়ে দেয়ার ভংগী করতেই হাত থেকে নিয়ে নিলাম সেটা! কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই এমনভাবে কথা বলতে শুরু করল যেন সে কতোদিনের চেনা। বললো- ‘তোমার নাম কি? কি করো?’  উত্তর শোনার ধৈর্য তার ছিলোনা! তার নাম জিজ্ঞাসা করলাম। কিন্তু সে প্রশ্নে বিন্দুমাত্র মনোযোগ না দিয়ে এবার দৌড় লাগালো দেয়ালের ইলেকট্রিক বোর্ডে লাগানো তার এ হাত লাগাতে! এবার মা সর্বশক্তি দিয়ে জাপটে আটকালো তাকে! ফুটফুটে ছেলেটার সমস্যা ছিল অতি চঞ্চলতা, আটকাতে গেলে রেগে উঠত খুব, সাথে যোগ হয়েছিল মনোযোগহীনতা! প্রথম দিকে ব্যাপারটাকে বাচ্চাদের স্বভাবসুলভ দুরন্তপনা ভাবলেও স্কুলে ভর্তি করার পর যখন পড়াশুনা শিখতে, হোমওয়ার্ক করতে সমস্যা শুরু হলো, ক্লাসে একটানা তাকে বসিয়ে রাখাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লো তখন তার মা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন!

দুরন্তপনা শিশুদের বৈশিষ্ট্য হলেও অতিমাত্রায় এর উপস্থিতি অসুস্থতা হিসেবে গণ্য করা হয়। তেমনি শিশুদের অতি দুরন্তপনা রোগের নাম “এটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার”। এটি মস্তিস্কের বিকাশজনিত একটি রোগ বা নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার যা শিশু, কিশোর এমনকি বড়দেরও হতে পারে। এই রোগে ভোগা শিশুদের মনোযোগের অভাব বা আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা থাকে এবং তারা অতিরিক্ত চঞ্চল হতে পারে। সাধারনত দেড়-দুই বছর বয়স থেকেই শিশুদের এই রোগ শুরু হয় যা কিনা পরিণত বয়স পর্যন্ত থেকে যেতে পারে। অনেক সময় পরিণত বয়সের পূর্বে এই রোগটি ধরা যায় না। শিশুরা স্কুলে যাওয়া শুরু করলে সাধারণত এর লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে,তবে খুব তীব্র হলে ৩ বছর বয়সেই সমস্যাগুলো বোঝা যেতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে সারা বিশ্বে ১৮ বছরের নিচে এই রোগে ভোগা শিশুদের সংখ্যা ১২৯ মিলিয়ন বা ৭.২ ভাগ যা কিনা স্কুলে যাওয়া শিশুদের মধ্যে ১০০ জনে  ৫ জন। আর বড়দের মধ্যে এই রোগে ভোগার সংখ্যা প্রায় ২.৫ ভাগ। ছেলে শিশুদের ক্ষেত্রে এই রোগের মাত্রা মেয়ে শিশুদের তুলনায় ৩ গুন।

লক্ষণসমূহঃ

সাধারণত ১২ বছরের পূর্বে শুরু হয়ে ৬ মাসের অধিক সময় ধরে দুই বা ততোধিক স্থানে যেমন বাড়ি, স্কুল বা অন্য কোন স্থানে শিশুর এই আচরণগুলো লক্ষ্য করা যায় এবং এর ফলে শিশুর পরিবারে ও স্কুলের কাজে ব্যঘাত ঘটে। সাধারণত তিন ধরণের সমস্যা দেখা যায়। যেমনঃ  ১। মনোযোগ জনিত সমস্যা  ২। অতিচঞ্চলতা এবং ৩। হটকারিতা

মনোযোগ জনিত সমস্যাঃ

. কোন কাজে বা খেলায় মনোযোগ দিতে বা ধরে রাখতে পারে না। মনোযোগ সহকারে কোন কথা শোনে না বা নির্দেশ অনুযায়ী স্কুলে বা বাসায় অর্পিত কাজ বা দায়িত্ব গুছিয়ে পালন করতে পারেনা।

২. খুব সহজ ভুল করে ফেলে এবং স্কুলের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রায়ই হারিয়ে ফেলে। যেমনঃ খেলনা, পেন্সিল,বই অথবা যন্ত্রপাতি ইত্যাদি।

. খুব সহজে বিভ্রান্ত হয় এবং কোন কাজ শুরু করতে যেমন কঠিন মনে করে তেমনি এক কাজ ঠিকমত শেষ না হতেই আরেক কাজে চলে যায় কিংবা প্রায় প্রতিদিনের কাজের কথা ভুলে যায় ।

অতিচঞ্চলতাঃ

. অতিরিক্ত অস্থির থাকে , ছুটাছুটি করে এবং কোন জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারে না এমনকি যেখানে স্থির হয়ে বসে থাকা জরুরি সেখানে তারা সুস্থির হতে পারে না।

. অবসর সময়ে বা খেলাধুলায় স্থির থাকতে পারে না এমনকি নিষেধ আছে এমন স্থানে দৌড়ে বেড়ায়, লাফালাফি করে বা উঠে পরে ।

. প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি কথা বলে এবং  অন্যদের কথার মাঝে বাঁধা দেয় এবং তার কথা বলার সুযোগ না আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারে না ।

হটকারিতাঃ

১. কোন কিছু না দেখে রাস্তায় ঢিল ছোঁড়া, রাস্তায় হাটতে হাটতে হঠাৎ দৌড় দেয়া।

২. ভবিষ্যত বিবেচনা না করেই গুরুত্বপুর্ন সিদ্ধান্ত হুট করে নিয়ে ফেলা।

৩. অন্যদের কথাবার্তা বা খেলাধুলার মধ্যে প্রায়ই ব্যাঘাত ঘটানো।

লক্ষণগুলোর উপর ভিত্তি করে একে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়ঃ ১। প্রধানত অতিচঞ্চল/ হটকারী ২। প্রধাণত অমনোযোগী এবং ৩। এই দুইয়ের সম্মিলন।

এই রোগের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও জানা না গেলেও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে এর কারণ একটি নয় বরং অনেক গুলো কারণে এই রোগটি হয়। যেমন- বংশগতঃ ৭৫ ভাগ কারণ বংশগত; রাসায়নিকের হ্রাস-বৃদ্ধিঃ যেমন- ডোপামিন (Dopamine), এপিনেফরিনের (Epinephrine) হ্রাস বৃদ্ধি। এছাড়া গবেষণায় আরো কিছু কারণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে পরিবেশগত কিছু কারণ, যেমন  ছোটবেলায় কীটনাশক বা লেড(lead) এর সংস্পর্শে আসার বিষয়টি সংযুক্ত থাকতে পারে! আরো দেখা গিয়েছে মাতৃত্বকালীন সময়ে কিছু ঘটনা, যেমন- জন্মের সময় আঘাত, বাচ্চার ওজন কম হওয়া, মাতৃত্বকালিন সময় নেশাদ্রব্য যেমন মদ্যপান বা ধুমপান করা, গর্ভাবস্থায় অন্য কোন শারিরিক অথবা মানসিক সমস্যা ইত্যাদি এই রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। গবেষকদের মতে পারিবারিক বিষণ্ণতার উপস্থিতি/ ইতিহাস ও এই রোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আবার কিছু কিছু বিষয় এই রোগের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিতে পারে, যেমন- অনেক বেশী টেলিভিশন দেখলে। কিছু খাদ্যাভ্যাস যেমন- চিনি জাতীয় খাবার, অতিরিক্ত লবনাক্ত খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড (Fast food), খাদ্য সংরক্ষিত উপাদানযুক্ত খাবার, রং মেশানো খাবার, কোকাকোলা, এনার্জি ড্রিংক, চকলেট ইত্যাদি বেশি খেলেও বাড়তে পারে। আবার পারিবারিক সমস্যা, দ্বন্দ্ব বা অভাব থাকলে এবং জীবনে কোন খারাপ ঘটনা ঘটলে এই রোগের তীব্রতা বাড়তে পারে! এছাড়াও সন্তানের প্রতি বাবা-মার আচরণে সমস্যা (অতি মনোযোগিতা, অতি উদাসীনতা, শিশু পালনে মা-বাবার মধ্যে অসমঞ্জস্যতা) অতি চঞ্চলতার সমস্যাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই অতি চঞ্চলতা বা এডিএইচডি এর লক্ষণ পাওয়া গেলে উপরোক্ত বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া অতীব জরুরি।

এই রোগে আক্রান্তরাও ভবিষ্যতে সফল ভাবে জীবন যাপন করতে পারে যদি সময়মত রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। তা না হলে এই রোগ দীর্ঘদিন থেকে যেতে পারে এবং এর সাথে অন্যান্য সমস্যাও দেখা দিতে পারে। অনেক সময় এটা কিশোর বয়স ও পরিণত বয়স পর্যন্তও থাকতে পারে। শিশু বয়সে শুরু হয়ে প্রায় ৫০-৮০ ভাগ কিশোর বয়স পর্যন্ত এবং ৩৫-৬৫ ভাগ পরিণত বয়স পর্যন্ত থেকে যেতে পারে। “এটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার” রোগের ১০-২৫ ভাগ রোগী নেশার সাথে জড়িয়ে পড়তে পারে। ৩০-৫০ ভাগ ক্ষেত্রে স্কুলের ফলাফল দিন দিন খারাপ হতে থাকে।

এই রোগ নির্ণয়ে কোন সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই। রোগী, রোগীর পরিবার, প্রয়োজনে স্কুলের শিক্ষক, খেলার সাথী, আত্মীয়স্বজন এমনকি প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এ রোগ নির্ণয় করা যায়। রক্ত, প্রস্রাব বা মস্তিষ্কের কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এই রোগ নির্ণয়ে দরকার হয় না।

বর্তমানে এই রোগের জন্য সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। প্রয়োজনে ঔষধের পাশাপাশি পিতা-মাতা আচরণগত শিক্ষা বা প্যারেন্টিং ট্রেইনিং, চাপ নিয়ন্ত্রণে শিশু ও পিতা-মাতা কে ফ্যামিলি থেরাপি, কগনিটিভ বিহেভিয়রাল থেরাপির মাধ্যমে সামগ্রিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়। এই রোগের লক্ষণসমূহ কোন শিশুর মধ্যে আংশিক বা পূর্ণভাবে দেখা দিলে অতিসত্বর মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করাতে হবে। যতো দ্রুততার সাথে চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হবে রোগীর উন্নতির সম্ভাবনা ততো বেশি থাকবে।

লিখেছেনঃ অধ্যাপক ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোরশেদ
চেয়ারম্যান, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪

Previous articleযানজট বয়ে আনে মানসিক অশান্তি
Next articleআমার মনে হতে থাকে, আমি মারা যাব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here