করোনাভাইরাস: জরুরী বিভাগে কর্মরত এক ডাক্তারের বর্ণনা

0
32
করোনাভাইরাস: জরুরী বিভাগে কর্মরত এক ডাক্তারের বর্ণনা
করোনাভাইরাস: জরুরী বিভাগে কর্মরত এক ডাক্তারের বর্ণনা

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রিটেনের হাসপাতালগুলো এখন যুদ্ধক্ষেত্র, আর এই যুদ্ধের একবারে সামনের কাতারে আছেন হাসপাতালগুলোর জরুরী বিভাগের স্বাস্থ্যকর্মীরা। ডা. বিশ্বজিৎ রায় কাজ করছেন লণ্ডনের উলউইচে কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালের ইমার্জেন্সীতে। করোনাভাইরাসের মহামারীতে প্রতিদিন তাদের কাছে অবিরাম আসছে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা বহু রোগী। বিবিসি বাংলার কাছে তিনি বর্ণনা করেছেন এসব মানুষের জীবন বাঁচাতে তাদের প্রতিদিনের লড়াইয়ের কথা। মনের খবর পাঠকদের জন্য বিবিসি’তে প্রকাশিত সেই বর্ণনা:

খুব কঠিন একটা দিনের কথা দিয়ে শুরু করি। সেদিন আমার শিফট শুরু হয়েছিল সকাল দশটায়। সেদিন আমার ডিউটি ক্রিটিক্যাল কেয়ারে। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর আমার কনসালট্যান্ট চিকিৎসক আমাকে ডাকলেন। বললেন, তুমি ক্রিটিকাল কেয়ারে যাচ্ছো, তোমাকে জানিয়ে রাখি,, দুজন পেশেন্ট আসবে। পথে আছে।
হাসপাতালের ক্রিটিকাল কেয়ারে অ্যাম্বুলেন্সে যখন রোগী আসে, অ্যাম্বুলেন্স কর্মীরা আমাদের আগেই আগাম বার্তা দিয়ে রাখে। যাতে আমরা সব প্রস্তুত রাখতে পারি। পেশেন্ট আসার সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে যাতে আমরা ট্রিটমেন্ট শুরু করে দিতে পারি।
রোগী সম্পর্কে যতটুকু জানলাম, তা হলো, বয়স ৪৩। বাসায় ছিল। তার প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট। কথা বলতে পারছে না। আমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে রিসাসিটেশন ডিপার্টমেন্টে ঢুকে গেলাম। দশ মিনিট পরেই রোগী আনা হলো। খুব সুঠাম দেহী। অ্যাম্বুলেন্সের কর্মীরা আমাকে জানালেন, রোগী একটু ডায়াবেটিক, কিন্তু নিয়মিত ঔষধ নেয়। নিয়মিত ব্যায়াম করে।
যখনই কোন রোগীর শ্বাস কষ্ট হয়, তার অক্সিজেনের মাত্রাটা আমরা মেপে নেই। দেখা যাচ্ছে যে এই রোগীকে হাই ফ্লো অক্সিজেন দেয়ার পরও তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন আকাঙ্খিত লেভেলে নেই। হাই ফ্লো অক্সিজেন দিলে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯০/৯৫ এর উপরে থাকা উচিৎ, কিন্তু এই রোগীর বেলায় তা ৮২/৮৩তে। কখনো ৭০ এ নেমে যাচ্ছে। এটা খুবই উদ্বেগের ব্যাপার। তখন আমি সাথে সাথে আমাদের অন্য সহকর্মীদের ডেকে আনলাম। সবাই চলে আসলো। রোগীর অবস্থা দেখে আমরা ঠিক করলাম, তাকে , তাকে ইনটিউবেট (শ্বাসনালীতে টিউব ঢোকানো, যাতে করে ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখা যায় ) করতে হবে।
রোগীর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু তখনো তার চেতনা আছে। তাকে আমরা বোঝালাম, তোমার ভালোর জন্য আমরা তোমাকে ইনটিউবেট করবো এবং কৃত্রিমভাবে ফুসফুসে অক্সিজেন সাপ্লাই দেয়া হবে। সেজন্য তোমাকে অচেতন করার দরকার হবে। রোগী তখন আমাকে বললো, আমার মা আছে। আমার মাকে আমিই দেখাশোনা করি। আমার মাকে কিন্তু আমি কিছু বলে আসতে পারিনি।
কথাটা আমার মনে খুব ধাক্কা দিল। এরকম একজন মানুষ, তার মাকে ঠিকমত বলে আসতে পারেনি, জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে এই লড়াইয়ের সময় সেটাই তার সবার আগে মনে হচ্ছে। দশ মিনিটের মধ্যে অ্যানেসথেসিস্ট চলে আসলো। রোগীকে অচেতন করে ইনটিউবেট করা হলো। ইমার্জেন্সী থেকে পরে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো আইসিইউতে।
এই রোগীর অবস্থা সম্পর্কে আমি পরে খবর নিয়েছি। এখনো ভেন্টিলেটরে আছে। তার কিডনি ঠিকমত কাজ করছে না। হিমোফিলট্রেশন করতে হচ্ছে। এটা উদ্বেগের। আমার এখনো কানে বাজছে তার কথাগুলো। সে বলেছিল, মায়ের প্রতি আমার অনেক দায়িত্ব। মাকে বলে আসতে পারিনি।আমি এই লোকটির জন্য প্রার্থনা করি। প্রার্থনা করি, বিধাতা যেন এই লোকটিকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
সামনের কাতারের সৈনিক
ইমার্জেন্সীতে আমরা যে ডাক্তাররা কাজ করি, আমাদের শিফট হচ্ছে দশ ঘন্টার। নার্সদের শিফট ১২ ঘন্টা। কিন্তু কখনো কখনো আমাদের কাজ করতে হয় আরও লম্বা সময় ধরে। এই মহামারির জন্য আমাদের হাসপাতালের প্রস্তুতি ভালোই বলতে হবে। আমাদের কর্তৃপক্ষ আগেই আমাদের সবার সঙ্গে কথা বলে পরিকল্পনা তৈরি করেছিল কিভাবে তারা এত রোগীর চাপ সামলাবে।
আমাদের একটা শিফট আছে সকাল আটটা থেকে। দশ ঘন্টার শিফট। আমি সাধারণত বিকেল চারটা থেকে রাত দুইটার শিফটে কাজ করি। প্রতিদিন কাজে যাই, আমার পরিবার স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগে থাকে আমাকে নিয়ে। তাদের আমি বলেছি, আমাকে ডাক্তার হিসেবে যেতেই হবে। এটা আমার কর্মক্ষেত্র। এই যুদ্ধে আমাকে নামতেই হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক তো না বলতে পারে না।
আমার স্ত্রীও এনএইচএসে (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস) কাজ করেন। প্রথম দিকে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তাকেও কাজে যেতে হয়। আর এখানে কেউ তো বসে নেই, এই দুর্যোগে সবাই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ডাক্তার, নার্স, হেলথ কেয়ার এসিস্ট্যান্ট, পোর্টার, সবাই কাজ করছে। আমাদের শত্রু অদৃশ্য। এই ভাইরাসের মোকাবেলা করতে হবে।
বাঁচানোর জন্য তিন মিনিট সময়
গত পরশুদিন আমার দায়িত্ব ছিল ইমার্জেন্সীর রিসাসিটেশনে । এক মহিলা রোগীকে আনা হলো। ৯১ বছর বয়স। তার হিস্ট্রি নিলাম। একা থাকেন এই ৯১ বছর বয়সেও। বাজার করা থেকে সব কাজ একাই করেন স্বাধীনভাবে, কারও সাহায্য ছাড়া। সোশ্যাল সার্ভিস থেকে তার দেখাশোনার জন্য দুজন সেবাকর্মী দেয়া হয়েছিল, সকালে একজন, বিকালে আরেকজন আসতেন। কিন্তু তিনি একজনকে না করে দিলেন, অন্যজন আছে। প্রতিদিন তার খবর নেন। এগুলো আমরা জেনেছি পরে সোশ্যাল সার্ভিসের কাছ থেকে।
৯১ বছর বয়স হলেও তেমন কোন স্বাস্থ্যগত সমস্যা নাই। কিন্তু হঠাৎ কদিন ধরে তার জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট। খেতে পারছিলেন না। তখন তার সেবাকর্মী অ্যাম্বুলেন্স ডাকে। অ্যাম্বুলেন্স কর্মীরা দেখলো তার অবস্থা সংকটজনক, সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমরা খবর পেয়েই তৈরি। যখন আমার কাছে রোগীকে হস্তান্তর করা হলো, আমি আশা করেছিলাম, রোগীর অবস্থা অতটা খারাপ হয়তো হবে না। কিন্তু যখন আসলো, দেখা গেল, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মাত্র ৫৭ শতাংশ।
ইমার্জেন্সীতে কোন রোগী আসার সাথে সাথেই কিন্তু তার চিকিৎসা শুরু হয়ে যায়। প্রথমে হাইফ্লো অক্সিজেন। এরপর সিপ্যাপ (কন্টিনিউয়াস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেশার) এরপর সর্বশেষ ধাপে ইনটিউবেশন।যখন দেখলাম রোগীর দেহে অক্সিজেনের মাত্রা একেবারে কম, মাত্র ৫৭, সাথে সাথে আমি ইমার্জেন্সী বেলে চাপ দিলাম। যাতে অ্যানেসথেসিস্ট এবং অন্যান্যরা চলে আসে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের কাছে আসার তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যে মহিলা তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ডাক্তার হিসেবে আমরা কিছু করার সুযোগই পেলাম না। অন্তত চেষ্টাটা তো করতে পারতাম।
এই ঘটনাটিও হয়তো আমার সারাজীবন মনে থাকবে। ডাক্তার হিসেবে আমরা কিছু করার সুযোগই পেলাম না। আমি বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। আমার সঙ্গে যে নার্স ছিল, সেও খুবই আপসেট। আমি তাৎক্ষণিকভাবে ক্রিটিক্যাল কেয়ার রুম থেকে বেরিয়ে আসি। আধাঘন্টা একটা রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম। এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে বাইরে গিয়ে চা খেলাম। আবার কাজে ফিরলাম।
প্রতিদিন ইমার্জেন্সীতে এরকম মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা রোগীদের নিয়ে আমি কাজ করি। সেখানে কত রকমের রোগী আসে। বিভিন্ন ধরণের অ্যাকসিডেন্টর রোগী। অবর্ণনীয়। হাত ভাঙ্গা। পা ভাঙ্গা। মাথায় ইনজুরি। আমরা এতে অভ্যস্ত। সাধারণ সময়ে কোন কেয়ার হোম থেকে খুব বৃদ্ধ রোগীও পাই বার্ধক্যজনিত কারণে যার অবস্থা খারাপ হচ্ছে। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি, সেটাকে আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত এরকম এত পেশেন্ট আমরা পাই না।
আমাকে দিনে দশ ঘন্টার যে শিফট করতে হয়,তাতে আটজন পর্যন্ত এমন রোগী দেখতে পারি। এরা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা রোগী। হয়তো দেখা গেল, আট জন রোগীর পাঁচজনকেই ইনটিউবেশন করতে হলো। এদের ইমার্জেন্সী থেকে এরপর ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নেয়া হয়। দিনের শেষে আমরা হয়তো খবর পাই, যে পাঁচজনকে আমরা পাঠিয়েছি, তাদের দুই বা তিনজনকে বাঁচানো যায়নি।
আমরা ডাক্তার, কিন্তু আমরাও তো মানুষ। আমাদেরও আবেগ আছে। ডাক্তার হিসেবে হয়তো সেই আবেগ আমরা প্রকাশ করি না। কিন্তু এসবের একটা মানসিক প্রতিঘাত পড়ে আমাদের ওপর। আমাদের কনসালট্যান্ট চিকিৎসক যারা, তারা প্রতিনিয়ত আমাদের সঙ্গে কথা বলেন, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক আছে কিনা। আমরা এই ধকল নিতে পারছি কিনা।
আজকে আমাকে দুঘন্টা আগে কাজে যেতে বলা হয়েছে। হাসপাতালে অবিরাম রোগী আসছে। অনেক চাপ। তাই আমাকে অনুরোধ করেছে, পারলে যেন দুঘন্টা আগে যাই। আমাদের একেকটা শিফটে গড়ে ২০ হতে ২২ জন ডাক্তার আর প্রায় ৪০ জন নার্স কাজ করে। যদিও আমার দশ ঘন্টার শিফট, দশ ঘন্টায় শেষ হয় না, অনেক সময় ১২/১৪ ঘন্টা হয়ে যায়। নার্সদেরও কাজ শেষ করতে দেরি হয়। এনএইসএসের কর্মীরা এখন সময়ের দিকে তাকাচ্ছে না। তারা সবাই যতটুকু পারে তাদের সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
একটানা তিন চার ঘন্টা কাজের পর আমরা হয়তো একটু হাঁপিয়ে উঠি। আমাদের যে পিপিই পরতে হয়, এগুলো কিন্তু মাথা থেকে পা পর্যন্ত। একটানা বেশি সময় এগুলো পরে থাকা যায় না। যদিও এর ভেতরে আমরা সুরক্ষিত থাকি, কিন্তু গরমে আমরা ডিহাইড্রটেড হয়ে যাই। কাজেই তিন চার ঘন্টা পর বেরিয়ে স্টাফরুমে যাই, একটু বিশ্রাম নিতে। তখন দেখি, সেখানে আশেপাশের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট থেকে, বিভিন্ন ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে নানা রকম স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পাঠিয়েছে আমাদের জন্য। আমাদের জন্য রেখে যাচ্ছে।
১২ ঘন্টার কাজ শেষে যখন ঘরে ফিরি, তখন ভীষণ ক্লান্ত থাকি। যা খাওয়ার আমি সাধারণত হাসপাতালেই খেয়ে নেই। বাসায় এসে শাওয়ার নিয়েই ঘুমাতে চলে যাই। চেষ্টা করি অন্তত ৬ ঘন্টার একটা পরিপূর্ণ ঘুম দিতে। আমাদের শারীরিক শক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য ঘুমটা খুব দরকার। কারণ পরদিন সকালে তো আমাকে আবারও যুদ্ধে যেতে হবে। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মানুষের জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ।
সূত্র: বিবিসি

Previous articleকোভিড-১৯: অন্যান্য রোগের উপসর্গ নিয়েও আবির্ভূত হচ্ছে
Next articleকোভিড ১৯: মানসিক চাপে ভুগছেন সিকিউরিটি গার্ড পেশায় কর্মরতরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here