সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসায় শিল্পকলার ভূমিকা

0
49
সিজোফ্রেনিয়া এমন একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং গুরুতর মানসিক অসুস্থতা, যা প্রাত্যহিক কাজকর্মে বাধার সৃষ্টি করে
শিল্পকলার মাধ্যমে চিকিৎসা বলতে কী বোঝায়?
শিল্পের কলা-কৌশল বা এর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বিষয়কে ব্যবহার করে অনেক সময় চিকিৎসক এক অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করেন। রং, মাটির মতো শিল্পকলার আরও অন্যান্য উপাদানকে অবলম্বন করে মনোরোগীরা তাঁদের অন্তর্নিহিত চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে সমর্থ হন। নাচ, গান বা অঙ্গসঞ্চালনের মতো বিষয়, যেগুলি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির অঙ্গ, সেগুলিই মূলত শিল্পের সাহায্যে নির্মিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এগুলি মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার সমাধানে খুবই কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। কলাবিদ্যার লক্ষ্য শুধু ছবি আঁকা বা শৈল্পিক দক্ষতা অর্জন নয়, মানুষের বিভিন্ন অনুভূতি এবং সংবেদনের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শিল্পকলার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
(বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ শিল্পকলার নানা রূপের মধ্যে রয়েছে গান, নাচ, নাটক প্রভৃতি বিষয়। এই প্রবন্ধে কেবল দৃশ্যমান শিল্পমাধ্যমগুলি আলোচিত হয়েছে।)
সিজোফ্রেনিয়া নিরাময়ে শিল্পকলার অবদান
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের মূল লক্ষণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সম্মোহন (Hallucinations) এবং মানসিক বিকৃতি বা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হওয়া (Distorted or false perceptions)। এই লক্ষণগুলি অনেক সময়েই রোগীর পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের কাছে বোধগম্য হয় না। এই অবস্থায় চারুকলার সাহায্যে চিকিৎসা খুবই উপযোগী—

  • শিল্পকলার সাহায্যে কোনও শব্দের ব্যবহার না করেই রোগী তার অনুভূতি এবং মনের ভাব প্রকাশে সক্ষম হয়। এর ফলে রোগীর সমস্যা বোঝা তার পরিজন ও বন্ধুদের পক্ষে সহজ হয়।
  • ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মতো এহেন চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমেও সিজোফ্রেনিয়া রোগীরা ঘুম-ঘুম ভাব, কাজে অনীহা ইত্যাদি সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারে।

“শিল্পকলা একজন সিজোফ্রেনিয়ার রোগীকে তার রোগের উপসর্গগুলি যেমন—এলোমেলো চিন্তাভাবনা, কানে দূর থেকে প্রচন্ড শব্দ ভেসে আসার অনুভূতি প্রভৃতি থেকে মুক্তি দিতে পারে। এক থেকে দুই ঘণ্টার চিকিৎসায় এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি তার নির্ধারিত কার্যাবলীর প্রতি মনোনিবেশ করে এবং বাকি অন্যান্য বিষয় নিয়ে মাথাই ঘামায় না। শুধু ফোরামের দেওয়া সৃষ্টিশীল কাজের  প্রতিই সে আকর্ষণ বোধ করে”—সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসায় নিয়োজিত ‘আশা’ নামক একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রের একজন বিশেষজ্ঞ এই তথ্য প্রকাশ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ব্যাঙ্গালোরের রিচমন্ড ফেলোশিপ সোসাইটির অধীনস্থ এই প্রতিষ্ঠানটি সিজোফ্রেনিয়া ও বাইপোলার বিকারজনিত সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কাছে তাদের নিজের বাড়ি-ঘরের সমান।
এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে কী কী বিষয় যুক্ত থাকে?
দৃশ্যমান শিল্পকলার সাহায্যে যে চিকিৎসা হয় তাতে একটি ছোট দল বা একক ব্যক্তির সঙ্গে চিকিৎসকের যোগাযোগ স্থাপন হয়। দলগতভাবে থাকার ফলে রোগগ্রস্ত ব্যক্তিরা শুধু মনের যথাযথ ভাব প্রকাশেই সমর্থ হয় না, সমাজবদ্ধতার রীতি-নীতি সম্পর্কেও যথেষ্ঠ জ্ঞান অর্জন করে। এতে অংশগ্রহণকারীরা একে অপরের সঙ্গে যেমন ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে, তেমনই আবার দলগতভাবে কাজ করার  যোগ্যতাও লাভ করে। সব মিলিয়ে এই চলমান জগতের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করার সুযোগ মেলে এই ধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থায়।
“যখন আমরা এইভাবে ছোট ছোট দলে ভাগ করে চিকিৎসা করি, তখন তার মধ্য দিয়ে একপ্রকার প্রতিযোগিতার সূচনা হয়। আমরা রোগীদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা কাজ দিই আর কাজের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে তুলতে সচেষ্ট হই। এইভাবে সুস্থ প্রতিযোগিতা আরম্ভ হলে রোগীরা আত্মবিশ্বাস  ফিরে পায় এবং সামাজিকতার সঙ্গে পরিচিত হয়”, — এমনই মত পোষণ করেন পুনর্বাসন কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে এককভাবে যখন কোনও রোগীর চিকিৎসা চলে, তখন একজনের সঙ্গেই চিকিৎসকের কথাবার্তা হয়। এইসময় রোগীকে স্বাধীনভাবে তাঁর পছন্দ অনুযায়ী শিল্পকলা যেমন, রং করা, মাটি ব্যবহার করে তা দিয়ে কোনও শিল্প স্থাপনের মতো সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত করা হয়ে থাকে। এহেন পদ্ধতির মাধ্যমে সেই ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থান সম্পর্কে একটি ধারণা করার চেষ্টা করেন সংশ্লিষ্ট ওই চিকিৎসক। এই সময় রোগীর সৃষ্টিশীলতার থেকেও তাঁর মনের অন্ধকার বা মানসিক অস্বাভাবিকতা দূর করাই বিশেষজ্ঞের মূল উদ্দেশ্য। এইভাবে শিল্পকে মাধ্যম করে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত কোনও ব্যক্তির চিকিৎসা করে তাঁকে সুস্থ করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন একজন মনরোগ বিশারদ। একজন মানুষ, যিনি সিজোফ্রেনিয়ার মতো গুরুতর মনের রোগে ভুগছেন, তিনি শিল্পকলার মাধ্যমে নিজের মনের ভাবই শুধু প্রকাশ করতে পারেন না, অপরের সঙ্গে তা আদান-প্রদানও করতে পারেন। এই কাজের মধ্যে দিয়ে তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেন, তা তাঁর কাছে অভাবনীয়।
শিল্প-মাধ্যম আদতে চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবেই গণ্য হয়
সিজোফ্রেনিয়া এমন একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং গুরুতর মানসিক অসুস্থতা, যা প্রাত্যহিক কাজকর্মে বাধার সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে শিল্পকলার ব্যবহার রোগীর নেতিবাচক আচরণ যেমন, লক্ষ্যহীন জীবনযাপন, সমাজ-সংসার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া, অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে অনীহার মতো সমস্যা সমাধানে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। এহেন পরিপূরক ব্যবস্থার সঙ্গে যথাযথ ওষুধ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে রোগী রোগের মোকাবিলা করতে সমর্থ হন। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে সেই সব মানসিক রোগী বিশেষভাবে উপকার পান, যাঁরা তাঁদের রাগ, দুঃখ, হতাশার মতো অনুভূতিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না এবং এই কারণে তাঁরা সমাজের বোঝা হিসেবে বিবেচিত হন। ছবি আঁকা বা অন্যান্য শিল্প-সৃষ্টিতে মনোনিবেশের ফলে একদিকে তাঁরা যেমন নিজেদের কলঙ্কমোচনে সক্ষম হন, তেমন অপরদিকে তাঁদের পরিচর্যাকারীরাও এই পদ্ধতি অবলম্বন করে রোগীকে সুস্থ করার ক্ষেত্রে আশার আলো দেখতে পান।
এই ধরনের চিকিৎসা সাধারণতঃ কোথায় সংঘটিত হয়?
হাসপাতাল বা পুনর্বাসন কেন্দ্রেই এহেন চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সুপারিশ মতো একজন রোগী এইরকম স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যেতে পারেন। যদি অবিলম্বে রোগীর বাড়ির কাছাকাছি অবস্থিত এমন পুনর্বাসন কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তা খুবই কার্যকরী হয়।
 

Previous articleস্ট্রেস বা চাপ নিয়ন্ত্রণ করবেন যেভাবে
Next articleবদ্ধঘর বা লিফটে উঠলে দম বন্ধ হয়ে আসে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here