বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও করোনায় আতংকিত। ভয়বাহ এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের পাশাপাশি ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। ইতমধ্যে বাংলাদেশ পুলিশের তিনজন সদস্য করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। সারাদেশে আক্রান্ত হয়েছেন চার’শ এর বেশি পুলিশ সদস্য। এমতাবস্থায় কেমন আছে পুলিশ সদস্যদের মনোবল, তা জানতে মনের খবর এর সাথে কথা হয় বাংলাদেশ পুলিশ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রবিউল ইসলাম এর সাথে-
করোনাভাইরাস আতংককে কিভাবে দেখছেন?
করোনাভাইরাস একটি বৈশ্বিক সমস্যা। সারা পৃথিবীর মানুষই এই সমস্যা থেকে নিজেদেরকে বের করে আনার জন্য বিভিন্ন প্রয়াস গ্রহণ করছে। করোনা ভাইরাস নিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যেই আতঙ্ক রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও আতঙ্ক আছে। এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ, যদি এটা শনাক্ত না করা যায় তাহলে একজন থেকে আরেকজন কিংবা শত শত মানুষের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে যেতে পারে।তবে আমার এতে মোটেই আতিংকত বা উদ্বিগ্ন নই, আমরা সর্বোচ্চ পেশাদারী মনোভাব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আপনারা কিভাবে কাজ করছেন?
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পুলিশ তথা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের কাজ হচ্ছে মূলত আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে আমাদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য স্বাভাবিক কাজগুলি করে যাচ্ছি এবং সেই সাথে জনগণকে সচেতন করার জন্য আমরা ইতমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
সেগুলি সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
আমরা হ্যান্ডমাইক দিয়ে প্রচরণা চালাচ্ছি, রাস্তায় নেমে প্রচারণা চালাচ্ছি। আমরা মসজিদেরে মাইক থেকে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত সচেতনতা মূলক বার্তা প্রচারের ব্যবস্থা করেছি। এছাড়া আমরা ছোট ছোট জায়গার কাঁচাবাজারগুলিকে খোলা জায়াগায় স্থানান্তর করেছি। সেখানে সামাজিক দূরত্ব অর্থাৎ ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমরা ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি, সেই সাথে নিজেদের বাহিনীর পক্ষ থেকেও যতটা সম্ভব খাদ্য সহায়তা প্রদান করছি। আমরা হাসপাতালগুলিতে কাজের সহায়তা করছি। সাধারণ মানুষ যেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে সেজন্য কাজ করছি। অযাচিত ঘোরাফেরা বন্ধের জন্য আমরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট স্থাপণ করেছি। এছাড়া সরকার থেকে যখন যে সিদ্ধান্ত আসছে, সেটি বাস্তবায়নে আমরা সর্বদা সচেষ্ট রয়েছি।
এই যে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আপনারা কাজ করছেন। এটিকে কিভাবে দেখেন?
করোনা ভাইরাসের কারণে সাধারণ মানুষ কিংবা সরকারি বিভিন্ন বিভাগে কর্মরতরা ঘরে থাকার সুযোগ পেলেও পুলিশের সেই সুযোগ নেই। পুলিশ সারাক্ষণই জনগণের পাশে আছে এবং জনগণেরে পাশে থাকবে। সেই আলোকেই নানা ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আমরা আমাদের রাস্ট্রীয় দায়িত্ব, নৈতিক দায়িত্ব, নাগরিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। আমরা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বাহিনীর সদস্য। মানুষের প্রয়োজনে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সেবা দিব এই ব্রত নিয়েই আমরা কাজ করি।
ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য আপনাদের নিজেদের প্রস্তুতি কেমন?
অদৃশ্য এই ভাইরাসের হাত থেকে মুক্তি পেতে আমরা নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত রাখার চেষ্টা রেখে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। নিজেদের সুরক্ষার জন্য আমরা পিপিই, মাস্ক, গগলস, গ্লাবস পরিধান করে কাজ করছি।
দায়িত্ব পালনের সময় নিজেদের ভেতর উদ্বিগ্নতা কাজ করে না?
অদৃশ্য শত্রুকে মোকাবিলা করা একটু কঠিন, একে দেখা যায় না, ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। এরকম একটি শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে ভেতরে ভেতরে কিছুটা অন্যরকম অনুভূতি তো কাজ করেই, তবে আমরা পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দেশও জাতির স্বার্থে অকুতোভয়। দেশের মানুষকে রক্ষার জন্য নিজের প্রাণ বির্সজন দিতে পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্যও কুন্ঠা বোধ করে না। সর্বোপরি করোনাভাইরাসে আমরা পলিশ বাহিনীর সদস্যরা মোটেই আতংকিত নয়; কারণ, আমরা বিশ্বাস করি যে, যদি ডাক্তার এবং পুলিশ আতংকিত হয়ে পড়ে তাহলে এই করোনা মহামারী মোকাবিলা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। বাহিনীর সদস্য হিসেবে আমার উদ্বিগ্ন নয়, আমরা সর্তক।
পরিবারের সদস্যদের জন্য উদ্বিগ্নতা কাজ করে?
পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকলেও আমরাও কোনো না কোনো পরিবারের সন্তান, আমাদের বাবা-মা ভাই-বোন আছে, স্ত্রী সন্তান আছে। তাদের কথাও আমাদের ভাবতে হয়। যদিও পুলিশ বাহিনীর পরিবারের সদস্য হিসেবে তাদের মানসিক শক্তি অনেক বেশি, তারপরও তারা আমাদেরকে নিয়ে চিন্তা করেন, উদ্বিগ্ন থাকেন। তাদের কথা চিন্তা করতা আমরা ভাইরাস থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে বেশি সচেষ্ট হই, বেশি উৎসাহিত হই। আমরা চেষ্টা করি আমাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে যেন আমাদের দ্বারা আমাদের পরিবারের সদস্যরা এই অদৃশ্য ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত না হয়। তাই দায়িত্ব পালন শেষে আমারা স্বাস্থ্য নির্দেশিকা মোতাবেক পরিচ্ছন্ন হয়ে বাসায় প্রবেশ করি। সর্বোপরি, এটাই বলা যায় যে, পরিবারের জন্য চিন্তা আমাদের কাজের অনুপ্রেরণা বাড়ায়।
গত দুইদিনে তিনজন পুলশ সদস্য মারা গেলেন, আক্রান্ত চার’শ এর বেশি সদস্য। এটি আপনাদের মনোবলে আঘাত করবে কিনা?
মৃত্যু সকলের জন্যই অবধারিত, কেউই অমর নয়। সেই মৃত্যু যদি দেশের জন্য হয় তবে সেটা অবশ্যই গর্বের। পুলিশ বাহিনীতে যোগদানের পর থেকে প্রতিটি সদস্যই এই গর্বের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকে। তাই আমাদের বাহিনীর সহকর্মীদের মৃত্যু সংবাদ বা আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ আমাদের মনোবলে একটু চিড় ধরাতে পারে না। বরং এই মৃত্যু আমাদেরকে লক্ষ্য সাধনের জন্য আরো বেশি প্রত্যয়ী করে তোলে।
সাধারণ জনগণের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন?
আমরা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি, জনগণের প্রাণ রক্ষায় আমরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারেও প্রস্তুত। তাই জনসাধারণেরও উচিত আরেকটু দায়িত্বশীল হওয়া, জনগণ দায়িত্বশীল হলে আমাদের কাজ আরেকটু সহজ হওয়ার পাশাপাশি করোনা দুর্যোগ মোকাবিলা অনেক বেশি সহজ হয়ে যেত। আমি সবাইকে অনুরোধ করবো, সবাই যেন রাষ্ট্র, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত নির্দেশিকা মেনে চলেন। সবার ঐকান্তিক চেষ্টা এবং নাগরিক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে আমরা দ্রুতই এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠবো ইনশাআল্লাহ।