সব মানুষই কোন না কোন ভাবে মানসিক রোগী!

প্রায়ই একটা কথা শোনা যায়, ‘সব মানুষই কোন না কোন ভাবে মানসিক রোগী’, কিংবা ‘সব মানুষের মধ্যেই কিছু কিছু মানসিক রোগ আছে’। কেউ কেউ আবার কোন একটা নির্দিষ্ট পারসেন্টেস উল্লেখ করেও বলেন- মানুষতো এতো পারসেন্ট মানসিক রোগী।

– বাস্তবে এর তথ্যগত সত্যতা কতটুকু?
– কেন এই কথাগুলো চালু হলো?
– এর পিছনের উদ্দেশ্যই বা কি হতে পারে?

মানসিক রোগ বা সমস্যা নিয়ে পৃথিবীতে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে, হয়ে আসছে। আমাদের দেশেও বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে এবং বর্তমানেও চলছে। দেশে কিংবা বিদেশে কোথাও এমন কোন গবেষনার ফলাফল বা তথ্যের কথা জানা নেই যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সব মানুষের মাঝেই এতোভাগ মানসিক রোগ আছে বা সমস্যা আছে। তবে বড় বড় এমন অনেক গবেষনার ফল আছে, যেখানে বলা হয়েছে- প্রতি তিনজন বা প্রতি চারজনের মধ্যে অন্তত একজন জীবনের কোন না কোন সময় কোন একটি মানসিক রোগে ভুগতে পারেন বা ভুগেছেন বা ভুগছেন। পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন দেশে বা বিভিন্ন সংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এসব গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত ওযেবসাইড উইকিপেডিয়াতেও এসব বিষয়ের উপর পরিচালিত বেশ কয়েকটি গবেষনার ফলাফল দেয়া আছে, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন তথ্য থেকে শুরু করে সমগ্র ইউরোপের উপর চালিত গবেষনার ফলাফলও পাওয়া যাবে।

উইকিপিডিয়াতে উল্লেখ্য একটি ইন্টারেস্টিং তথ্য হলো, (ইউরোপে চালিত গবেষণার তথ্য অনুযায়ী) প্রতি দশ জনের মধ্যে অন্তত একজন, বছরের কোন না কোন সময়ে, কোন একটি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এখানে দেখা যাচ্ছে গবেষণাগুলি মূলতঃ কোন একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠিতে, নির্দিষ্ট সময়ে, কি পরিমান মানসিক রোগ পাওয়া যায় তার উপর পরিচালিত হয়েছে।

আমেরিকা ভিত্তিক অন্য একটি গবেষনায় বলা হয়েছে, প্রতি তিন জনের মধ্যে অন্তত এক জন বছরের কোন এক সময় ছোট-বড় কোন একটি মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। প্রায় একই রকমের তথ্য চীন বা অষ্ট্রেলিয়াতেও দেখা গেছে।

কিন্তু এমন কোন তথ্য কোথাও উল্লেখ নেই, যেখানে একজন নির্দিষ্ট মানুষের কতটুকু মানসিক সমস্যা আছে বা থাকতে পারে সেটার পার্সেন্টেস দেখানো হয়েছে। কোন কোন গবেষণায় অবশ্য একজন ব্যাক্তি মানুষের কোন একটি মানসিক রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সব মানুষের মাঝেই মানসিক সমস্যা আছে বা থাকে এমন কোন তথ্য কোথাও নেই!

কথা হলো এমন একটি প্রবাদ বা বিশ্বাস মানুষের মধ্যে থাকলে অসুবিধা কোথায়? বা আদৌ কোন অসুবিধা আছে কি?

উত্তর হলো, হ্যাঁ অসুবিধা আছে। অবশ্যই আছে। সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো যারা রোগে ভুগছেন তাঁদের। বিষয়টি এমন দাঁড়ায় যে, সবার মাঝে কোন না কোন মানসিক সমস্যা বা রোগতো এমনিতেই থাকে সুতরাং এসবের আবার চিকিৎসার দরকার কি? রোগের প্রয়োজনীয় গুরুত্বকে বা গ্রহনযোগ্যতাকে অনেকাংশে হালকা করে ফেলা হয় এসব বক্তব্য বা বিশ্বাসের মাধ্যমে। আর এতে করে ব্যাহত হয় মানসিক স্বাস্থ বিষয়ক প্রায় সব দিক। চিকিৎসা ব্যবস্থায়, প্রয়োজনী সতর্কতা অবলম্বনে এমনকি এ সংক্রান্ত সচেতনতা তৈরীর ক্ষেত্রে এসব বিশ্বাসের প্রভাব পরে। আমরা মাঝে মধ্যেই রোগীর আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে এমন কথাও শুনে থাকি যে, সবার মাঝে কিছু না কিছু সমস্যাতো আছেই, এই নিয়ে এতো চিন্তার কি আছে?

তবে একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে, মানসিক রোগ বা মানসিক সমস্যা এক কথা নয়। অনেকগুলো মানসিক সমস্যা এক সাথে মিলে নির্দিষ্ট কোন একটি মানসিক রোগ হয়ে থাকে। কিছু কিছু মানসিক সমস্যা সত্যি সত্যি মানুষের মাঝে থাকতেই পারে- কারো ঘুমের সমস্যা, কারো কোন একটি বিষয়ে টেনশান, কারো ভয় লাগা, বুক ধরফর করা এসব। তবে আলাদা আলাদা ভাবে এসব কোন একটি রোগের প্রকাশ নয়। বরং এসব মানুষের অতি সাধারন বৈশিষ্ট। ঠিক যে রকম ভাবে মানুষের শরিরের বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন সমস্যাও থাকতে পারে। মজার বিষয় হলো, কোন মানুষ কি শতভাগ শারীরিকভাবেও সুস্থ? কিন্তু এসব নিয়ে আমাদের ভাবতে হয় না!

যে যাই বলুক এসব কথায় কান না দিয়ে মনে রাখতে হবে, কখন একজন মানুষকে আমরা মানসিক ভাবে অসুস্থ মনে করবো এবং তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসবো। মনে রাখতে হবে, যখন কোন একজন মানুষ তার নিজের জন্য বা অন্যের জন্য ক্ষতির কারন হয়ে দাড়ায় তখনই তাকে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। একটি দুটি মানসিক সমস্যা থাকলেই সে মানসিক রোগী নয়, যেমন একটি দুটি শারিরীক সমস্যার জন্যও মানুষকে সব সময় ডাক্তারের স্মরনাপন্ন হতে হয়না।

কিন্তু ‘সব মানুষেরই কিছু কিছু মানসিক সমস্যা থাকে’ এসব বলে মানসিক রোগকে অবহেলা করাও উচিত নয়। কোন একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে নির্দিষ্ট কিছু সমস্যা হলেই তাকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিৎ, কোন রোগ হয়েছে কিনা তা দেখা উচিৎ। নির্দিষ্ট কোন মানসিক কারন থাকলেতো অবশ্যই এমনকি শারিরীক বিভিন্ন রোগের প্রভাবেও যদি কেউ মানসিকভাবে অস্বস্থি বোধ করে তাকেও মানসিক চিকিৎসার আওতায় আনা উচিৎ।

রোগ নিয়ে বসে থাকলে এমনিতেই রোগ চলে যাবে, এটা ভাবার কোনো কারন নেই। একই ভাবে, যে রোগের যে চিকিৎসা সেসব সঠিক ভাবে না করালেও একই সমস্যা হবে।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleআপনি যখন একটি গান শুনছেন তখন সেটি আপনার গান: রাহুল আনন্দ
Next articleআমার সমস্যা মাথা ব্যথা কিন্তু সবাই আমাকে মানসিক ডাক্তার দেখাতে বলছে
চেয়ারম্যান, মনোরোগবিদ্যাি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here