শিশু ও বয়ঃসন্ধিদের অবসাদ এবং উদ্বেগঃ পর্ব-১

0
23
মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সন্তানকে সচেতন করার কৌশল
অ্যাটেনশন ডেফিশিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডারের (এডিএইচডি) মতো অবসাদ ও উদ্বেগও শৈশবের একপ্রকার মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা, যার লক্ষণ সবসময়ে খালি চোখে ধরা পড়ে না। এই সমস্যার কারণে একটা বাচ্চার আচার-আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন দেখা দেয়। অভিভাবকদের চোখে সেই পরিবর্তন নাও ধরা পড়তে পারে।
বাচ্চাদের মধ্যে অবসাদ, উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা হলে তারা নিজেদের অনুভূতি বা বোধের প্রকাশ ঘটাতে পারে না।
একজন বয়ঃসন্ধি ছেলে বা মেয়ের মধ্যে মানসিক অবসাদের লক্ষণ দেখা দিতে পারে তাদের ১১ বা ১২ বছর বয়সে। এই পর্যায়টা হল সন্ধিক্ষণের, যখন একজন বাচ্চার মধ্যে শারীরিক, মানসিক এবং হরমোনজনিত পরিবর্তন ঘটে। অভিভাবক এবং শিক্ষক, যাঁরা বাচ্চাদের এই বদলগুলো দেখতে পান, তাঁরা অধিকাংশ সময়ে ওই লক্ষণগুলোকে এড়িয়ে যান। তাঁরা ভাবেন যে, বাচ্চা হয়তো কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থানে পৌঁছে যাবে। অন্যদিকে বাচ্চারা যত বড় হতে শুরু করে তত তাদের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন হতে থাকে। কিছু বাচ্চার মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাও দেখা দেয়, যা মোটেই এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। এক্ষেত্রে অভিভাবকরা যদি দেখেন বাচ্চার আচার-আচরণ স্বাভাবিক হচ্ছে না এবং সেই আচরণ ২ থেকে ৩ সপ্তাহ ধরে স্থায়ী হচ্ছে তাহলে অবশ্যই তাদের বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন।

শিশুদের ক্ষেত্রে নানারকম গুরুতর উদ্বেগের সমস্যা দেখা দেয়। একদম ছোট বাচ্চা যারা সবে হাঁটতে শিখেছে এবং এর থেকে আরেকটু বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এরকম উদ্বেগের সমস্যা খুব বেশি দেখা যায়। যদি এই সমস্যা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ৫ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং তার দৈনন্দিন কাজে সেই সমস্যার প্রভাব পড়ে তাহলে একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা অবশ্যই প্রয়োজন।
সামাজিক উদ্বেগজনিত সমস্যা: সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে বাচ্চারা অধীর হয়ে ওঠে।
ভয়জনিত (ফোবিক) উদ্বেগ: বাচ্চাদের মনে কতগুলো বিশেষ বিষয় নিয়ে ভয় দেখা দেয়। যেমন- কোনও জায়গা, উচ্চতা, জীবজন্তু, অন্ধকার প্রভৃতি।
বিচ্ছিন্নতাজনিত (সেপারেশন) উদ্বেগ: বাচ্চাদের মনে মাঝে মাঝে ভয় হয় যে তারা হয়তো অভিভাবক বা পরিচর্যাকারীদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে। ২ থেকে ৩ বছরের বাচ্চাদের মধ্যে এই ভয় দেখা দেয়।
বয়সে একটু বড় ও বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনার সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে উদ্বেগ জাগে।
পারফরম্যান্স অ্যাংজাইটি বা উদ্বেগ: এই উদ্বেগের কারণ হল নিজের জীবনের প্রত্যাশা পূরণ ও লেখাপড়ায় সবসময়ে সফল হতে চাওয়া। এই সমস্যা বয়ঃসন্ধিকালের সেই সব ছেলে-মেয়ের মধ্যে দেখা যায়, যারা লেখাপড়ায় শুধুই সেরা হতে চায়। কারণ তাদের মনে ভয় থাকে যে যদি তারা পড়াশোনায় সেরা হতে না পারে তাহলে তারা তাদের আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলবে। অন্যদিকে সেই সব ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও ভয় থাকে যারা লেখাপড়ায় তেমন ভালো নয়। এরা সবসময়ে নিজেদের ব্যর্থতার জন্য হীনম্মন্যতায় ভোগে। বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই উদ্বেগ জন্মায়। তাদের মনে বারবার কয়েকটি চিন্তা ঘুরেফিরে আসে- যদি আমি ব্যর্থ হই তাহলে কী হবে? যদি আমি জীবনে কিছু করে দেখাতে না পারি তাহলে কী হবে? যদি আমি তেমন ভালো কিছু করতে না পারি তাহলে কী হবে? আমি কি সব ক্ষেত্রেই সফল হব?

এখন প্রতিযোগিতার জগৎ। তাই বাচ্চাদের উপর পড়াশোনা এবং অন্যান্য গুণাবলি বিকাশের জন্য অহেতুক ও অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। এ কারণে একজন বাচ্চাকে কড়া নিয়মকানুন ও কঠিন রুটিন মেনে চলতে হয়। এটা একজন বাচ্চার মানসিক অবসাদের পিছনে অন্যতম কারণ। তাকে বাড়িতে ও স্কুলে বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয় লেখাপড়া ও কিছু না কিছু শেখার মধ্য দিয়ে। সেই সঙ্গে অন্যান্য আরও কয়েকটি মনস্তাত্ত্বিক উপাদান থাকে যা একজন শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। যে সব বাচ্চারা তাদের অনুভূতিগত ও মানসিক জটিলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে না তাদের ক্ষেত্রেই অবসাদের সমস্যা বেশি চোখে পড়ে।
যে যে কারণে অবসাদ হতে পারে সেগুলো হল-

  • বাড়িতে ঝগড়া-বিবাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ, যেমন- অভিভাবকরা যদি মদ্যপ হয় বা নিজেদের মধ্যে সবসময়ে ঝগড়া-বিবাদ করে
  • হিংসা, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন বা অবহেলার কারণে মানসিকভাবে আতঙ্ক জন্মায়
  • পড়াশুনা শেখার সমস্যা যা একজন বাচ্চার আত্মবিশ্বাস এবং দক্ষতার উপর
    প্রভাব ফেলে
  • চিকিৎসা হয়নি এমন অন্যান্য সাইকিয়াট্রিক সমস্যা, যেমন- উদ্বেগজনিত জটিলতা

বাচ্চাদের মধ্যে কম, মাঝারি বা গুরুতর অবসাদ দেখা যায়।
কম অবসাদ– এর ফলে শিশু অখুশি থাকে। কিন্তু তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। স্কুলের কাজ বা দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে তাদের তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। কিন্তু অভিভাবকদের সাহায্য এবং সরল জীবনযাত্রা শিশুদের এই সমস্যা থেকে রক্ষা করতে পারে।
মাঝারি অবসাদ– এর ফলে বাচ্চাদের জীবন অনেকটা প্রভাবিত হয়। বাচ্চারা সবসময়ে বিষণ্ণ ও মনমরা থাকে। যদি অভিভাবকরা বাচ্চার মধ্যে এরকম  অবসাদের লক্ষণ দেখতে পান তাহলে অবিলম্বে পারিবারিক চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে ও একজন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
গুরুতর অবসাদ – এর ফলে বাচ্চারা নিজেকে অপদার্থ বলে ভাবে। বাচ্চাদের মনে  সবসময়ে নেতিবাচক চিন্তাভাবনা হয় এবং সে তার দুঃখগুলোর সঙ্গে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারে না। যদি বাচ্চার মধ্যে এরকম গুরুতর মানসিক অবসাদ দেখা দেয় তাহলে তাকে তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখাতে হবে ও চিকিৎসা করাতে হবে।

Previous articleমাসিক মনের খবর এর মার্চ সংখ্যায় যা রয়েছে
Next articleসোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে বাড়ছে শিশুদের মানসিক সমস্যা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here