যৌনতা থেকেই মানবসভ্যতার ইতিহাস। এটি এমনই এক ভয়ঙ্কর জিনিস যে মানুষ যদি যৌনতায় লিপ্ত থেকে প্রজনন না করে তবে একদিন মানবসভ্যতারই বিলুপ্ত হবে। আর মানবসভ্যতার বিলুপ্তি মানেই পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরের মৃত্যু। ফলে যৌনতা এত জরুরি যে একে বাদ দিয়ে কিছুই হয় না। দর্শন, রাজনীতি, শিলপকলা সবই।’- বিখ্যাত লেখক আর্নেস্ট ফিশারের এই লেখার সাথে বাঙালিরা সহমত জানাতে দুইবার ভাববেন। অনেকে তো সামনাসামনি দ্বিমতও পোষণ করতে পারেন। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় যৌনতা এখনো এতটাই ট্যাবু হয়ে আছে। অথচ প্রাত্যহিক জীবনে যৌনতা মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদার একটি। আর উত্তম যৌনতার জন্য যে কারো মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ভীষণ জরুরী।
বর্তমান বাংলাদেশে যৌনতা নিয়ে এখনো খোলামেলা আলোচনা সম্ভব নয় বলেই অনেকেই নিজের সমস্যা এবং সমাধান নিয়ে সরাসরি আলোচনা করতে পারেন না। এমনকি ডাক্তারের কাছে গিয়েও দ্বিধাহীন আলোচনা করতে অনেকেই সংকোচবোধ করেন। ফলে সময়ের সঙ্গে তাদের মানসিক অস্বস্তি বাড়ে, অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। যার ফলে তাদের যৌন স্বাস্থ্য আরও অবনতির দিকে যেতে থাকে। আর এই যৌন স্বাস্থ্যের উন্নতির লক্ষ্যে সব মানুষেরই মানসিক স্বাস্থ্যের সঠিক বিকাশ হওয়া উচিত।
প্রথমে আমাদের বুঝা উচিত, মানসিক স্বাস্থ্য কী? শরীর ও মনের দিক থেকে সুস্থ অবস্থা ও পরিবেশের সাথে সুস্থ সংগতি বিধান করাকে মানসিক স্বাস্থ্য বলে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে মানুষের সকল আচরণই উদ্দেশ্যমুখী। এ উদ্দেশ্যমুখী আচরণের মূলে রয়েছে কতগুলো চাহিদা। মানুষ যদি বাস্তব জীবনের সকল সমস্যা ও সংকট মেনে নিয়ে তার চাহিদাগুলো স্বল্পতম সংঘর্ষ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করতে পারে তবে মানসিক তৃপ্তি লাভ হয় এবং সংগতি বিধান সম্ভব হয়। এ সার্থক সংগতি বিধানের মধ্যে দিয়েই মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা হয়।
অর্থাৎ বলা যায়, মানুষের চাহিদা অর্জিত হলেই তার মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা হয়। কিন্তু ব্যক্তি মানুষের সব চাহিদা কী পূরণ করা সম্ভব? নিঃসন্দেহে উত্তর না। সেক্ষেত্রে যেকোনো মানুষের সঠিক মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্যে পরিবারগুলোর শৈশব থেকেই কাজ করা উচিত। সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের সঠিক বিকাশের জন্য পরিবার যে কাজ করা উচিত।
সন্তানের সঠিক শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে খেয়াল রাখতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই শরীর ভালো না থাকলে মনও ভালো থাকে না। তাই মনকে ভালো রাখার জন্য সবার প্রথমে সুস্থ শরীর নিশ্চিত করতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও পরিবার থেকে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলার শিক্ষা দিতে হবে। মানসিক শক্তির বলে যেন যে কোনো পরিবেশ মোকাবিলা করতে পারে, তেমন দৃঢ চিত্তের করে গড়ে তুলতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো আত্মতৃপ্তি। আর তাই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলেই কিভাবে আত্মতৃপ্তি পাওয়া সম্ভব সেটাও শিখাতে হবে।
পরিবার থেকে সন্তানকে বোঝাতে হবে কতটুকু চাহিদায় তুষ্ট থাকা উচিত। শৈশবের সব চাহিদা পূরণ করলে একসময় সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে চাহিদার মাত্রা সম্পর্কে সবসময় সচেষ্ট রাখতে হবে। আর এই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে মানসিকভাবে প্রশান্তি এবং সুস্বাস্থ্য পাওয়া সম্ভব। আর সর্বোপরি নিজের আত্মমূল্যায়ন করা শিখতে হবে।
এছাড়াও সন্তানকে শৈশব থেকে যৌনতা সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়াও পরিবারের কাজ। যৌনতাকে ট্যাবু বানিয়ে রাখলে, পরবর্তীতে সেটা হিতে বিপরীত হিসেবে কাজ করতে পারে। আর তাই, যখন যেরকম সুযোগ আসে সেটাকে কাজে লাগিয়ে যৌনশিক্ষাও দেওয়া উচিত। যেমন, টিভিতে গর্ভবতী মহিলাকে দেখালে সহজ করে বলা যেতে পারে, মানুষের জন্ম প্রক্রিয়া সম্পর্কে। বিব্রতকর কোনো প্রশ্ন এলে বুঝিয়ে বলতে হবে। যৌনতার কোনো প্রসঙ্গ সামনে এলে সন্তানের কাছেই জানা যেতে পারে, এ বিষয়ে সে কেমন জানে!
এছাড়াও সন্তানের বয়স অনুযায়ী যতটুকু গ্রহণযোগ্য ততটুকু বলা উচিত। অবশ্যই মিথ্যা বলা উচিত নয়। এই শিক্ষা পরিবার থেকে দেওয়ার বড় সুবিধা হলো, সেক্ষেত্রে সন্তান অন্য কোনো উপায়ে লুকিয়ে ইউটিউব, নিষিদ্ধ সিনেমা এবং নিষিদ্ধ বইয়ের দিকে ঝুঁকবে না। যেখানে বেশিরভাগই মনগড়া থাকে। এছাড়াও যৌনতা বিষয়ক বিজ্ঞানসম্মত বিষয় তাদের সঙ্গে শেয়ার করলে ভালো।
সন্তানকে মূল্যবোধের শিক্ষাও দিতে হবে। এটা জানাতে হবে, যৌনতা পারস্পরিক অনুমতিসাপেক্ষ বিষয়। আর এই শিক্ষাগুলো সঠিক ভাবে দিতে পারলে, এটা বাকী জীবনের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে। যৌন স্বাস্থ্যের জন্য মানসিক এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলে, যে কেউ তার নিজের আচরণ সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতে পারবে। নিজের জায়গা থেকে বিষয়গুলো মানিয়ে নিতে পারবে।
যৌনতার ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে আরও কিছু সমস্যা দেখা যায়। যার অন্যতম কারণ হলো, যৌনতা নিয়ে আমাদের সমাজে ছড়িয়ে থাকা কুসংস্কার। এর ফলে যে সমস্যাগুলোর সৃষ্টি হয়, এটাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় মনোযৌন বলা হয়। এর ফলে সঙ্গীর প্রতি যৌন আকাঙ্খার অভাব দেখা যায়। অনেকের যৌন বিতৃষ্ণাও দেখা যায়। আবার পুরুষদের ক্ষেত্রে ইরেক্টাইল ডিসফাংসন, দ্রুত বা বিলম্বিত বীর্যপাত ইত্যাদিও দেখা যায়। তবে এসব কিছুর চিকিৎসা হয়েছে। এর জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এবং অবশ্যই আত্মবিশ্বাস নিয়ে সবকিছু খোলাখুলি বলতে হবে। আর যদি সমস্যাটা শারীরিক না হয়, তাহলে কেবল মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে দেখা করেই সমাধান সম্ভব।
বলা হয়ে থাকে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যতই সমস্যা থাকুক না কেন, চাওয়া পাওয়া না মিলুক, কিন্তু দিনশেষে তাদের মধ্যে চমৎকার একটি রোমান্টিক যৌন-সম্পর্ক বাকী সব সমস্যাকে গৌণ করে দিতে পারে। যৌন সম্পর্ক কেবল শারীরিক নয়, মানসিকও। তাই মানসিকভাবে নিজেকে সুস্থ ও চাঙ্গা রাখতে দারুণ যৌনতা প্রয়োজন উভয়েরই। যা সম্ভব কেবল উভয়েরই মানসিক স্বাস্থ্য সঠিক থাকলে। অর্থাৎ, মানসিক স্বাস্থ্য এবং যৌনতা একটি অপরটির পরিপূরক।
লিখেছেন: কামরুল ইসলাম ইমন
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে