যৌনচিন্তা বারবার আসা যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিক

ডা. এস এম আতিকুর রহমান

যৌন চিন্তা অনেক কারণেই বারবার আসে। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে এটা খুবই গর্হিত একটি কাজ। সামাজিকভাবেও বিষয়টা গ্রহণযোগ্য নয়।

যৌনতার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে, সেখানে বারবার যৌনচিন্তাকে নেতিবাচকভাবেই দেখা হয়েছে। যৌনচিন্তার বিষয়ে ধর্মের অবস্থান তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, কখনো কখনো যৌনচিন্তা বারবার আসে। শুধু বারবার চিন্তা আসা নয় বাধ্য হয়ে যৌনাচারেও লিপ্ত হতে হয় কোনো কোনো মানসিক অবস্থায়। সেই মানসিক অবস্থাগুলোই আজ তুলে ধরতে চাই। যৌক্তিক কি অযৌক্তিক সে বিবেচনা পাঠকের।

সেক্সচুয়াল অবসেসন

মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যখন যৌন চিন্তা আসে। সাধারণত অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারের রোগীদের মধ্যে এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়। প্রতি চল্লিশ জনের মধ্যে একজনের এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়। যৌনচিন্তার ধরনও থাকে একটু ভিন্ন ধরনের। যে ধরনের যৌনতা রোগীর কাঙ্খিত নয় সে ধরনের যৌন চিন্তা আসতে থাকে।

কখনোবা চিন্তা নয় আবেগীয় এক প্রবল ঝোঁক অনুভব করে ওরকম কিছু করে ফেলার। কখনো কল্পনা আসে এমন সব মানুষকে নিয়ে যাদের সঙ্গে শারীরিক মিলন কখনো সম্ভব নয়। তাই রোগী অনেক সময় ঘাবড়ে যায় এবং কষ্ট পেতে থাকে।

এক রোগীর কথা আমি জানি যিনি দীর্ঘ পাঁচ বছর খুব নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি, এই অনাকাঙ্খিত যৌনচিন্তার কারণে। এটা যে একটা রোগের কারণে হচ্ছে, সেটাও তিনি জানতে পেরেছেন পাঁচ বছর পরে চিকিৎসা গ্রহণের সময়।

অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারে যে ধরনের সেক্সচুয়াল অবসেসন বা যৌনচিন্তা আসে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে দেওয়া হলো-

১. পীড়াদায়ক, মনের বিরুদ্ধে ও রুচিতে মেলে না এমন ধরনের যৌনচিন্তা।

২. লজ্জাকর, অসঙ্গত, অযাচিত, যৌনাচারের কল্পনা।

৩. কারো ওপর জোর করছে অথবা অন্য কেউ তার ওপর জোর খাটাচ্ছে এমন চিন্তা।

৪. এসব চিন্তা বা কল্পনা আসার ভয়ে বারবার ক্ষমা চাওয়া।

৫. এসব চিন্তা এড়ানোর জন্য বিশেষ কোনো নিয়ম মেনে চলা।

সেক্সচুয়াল হ্যালুসিনেসন

অস্বাভাবিক আচরণযুক্ত মানসিক রোগ বা বাস্তবতা বিচ্ছিন্ন মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায়। কোনো ধরনের যৌন মিলন ছাড়াই তারা যৌন অনুভূতির অভিজ্ঞতা পেতে পারেন অন্য মানুষের কাছ থেকে।

একদম সত্যিকারের অনুভূতিই তারা পান। তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে-

১. সম্পূর্ণ সজাগ অবস্থায় এমন অভিজ্ঞতা লাভ করা।

২. চাইলে এ ধরনের অনুভূতি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে না পারা।

৩. নিজের ইচ্ছায় এ ধরনের অনুভূতি অনুভব করতে না পারা। অর্থাৎ কল্পনা যেমন নিজের ইচ্ছায় করা যায় কিন্তু এ ক্ষেত্রে এটা করা যায় না। শুধুমাত্র হ্যালসিনেসন যখন হয়, তখনই রোগী এটা অনুভব করে।

হাইপার সেক্সচুয়ালিটি

বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারের ম্যানিক অবস্থায় যৌন ইচ্ছা যেমন বেড়ে যায় তেমনি লজ্জা-শরম, সামাজিক বিবেচনা বোধও কমে যায়। তখন কারো কারো মধ্যে এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়।

মুড ডিজঅর্ডার মূলত আবেগের রোগ। অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ এই রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আনন্দের আবেগের মতো যৌন আবেগও এই রোগে বেড়ে যেতে পারে। সামাজিক বিধি নিষেধের বিষয়টা তার বোধে কাজ করে না।

শরীরে যৌন হরমোন টেস্টোস্টেরনের বৃদ্ধির কারণেও হাইপার সেক্সচুয়লিটি দেখা দিতে পারে। ব্রেইনের সামনের দিকের যে অংশটির নাম ফ্রন্টাল লোব সেটাতে টিউমার হলেও এ ধরনের হাইপার সেক্সচুয়ালিটি হয়।

মাদকাসক্তির কারণেও এমনটা হতে পারে। আবার অনেক সময় প্রেসক্রাইব্ড ঔষধের জন্যও এমনটা হয়ে থাকে। মোদ্দা কথা, ব্রেইনে ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার বেড়ে যাওয়ার কারণে এমনটা হয়।

টেসস্টোস্টেরন এবং ডোপামিন হাইপার সেক্সচুয়ালিটিতে ভূমিকা রাখে। বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে-

১. যৌন ইচ্ছা বা আকাঙ্খা বেড়ে যাওয়া।

২. বারবার যৌন চিন্তা, যৌন কল্পনা এবং যৌন কর্মে লিপ্ত হওয়া।

সেক্সচুয়াল অ্যাডিকশন

এটা একটা আচরণগত আসক্তি। যারা এ ধরনের আসক্তিতে ভোগেন তারা যে অতি মাত্রায় যৌন আকাঙ্খায় ভুগছেন বিষয়টা এমন নয়। এরা যৌনচিন্তা বা যৌন কল্পনা এবং যৌনাচার করতে পছন্দ করেন।

আনন্দ পাওয়ার জন্যই তারা এমনটা করেন। যৌনাচার না করে পারেন না, এমন একটা বাধ্যাবধকতাও থাকে তাদের মধ্যে। যৌনাসক্তির লক্ষণগুলো এ রকম-

১. যৌন বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ হারানো।

২. প্রতিনিয়ত এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকা।

৩. শারীরিক এবং মানসিক পরিণতি জানা সত্ত্বেও এসব থেকে নিজেকে বিরত রাখতে না পারা।

৪. জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবহেলা করা (ক্ষতিগ্রস্ত হবে জানা সত্ত্বেও)।

৫. একটা অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্খা অনুভব করা।

৬. সময় এবং অর্থের গুরুত্বপূর্ণ অপচয় করে ফেলা।

৭. ফোনসেক্স, সাইবার সেক্স, অর্থের বিনিময়ে সেক্সে লিপ্ত থাকা।

৮. একাধিক পরকীয়া সম্পর্কে জড়ানো।

৯. দাম্পত্য সম্পর্কে আগ্রহ কমে যাওয়া।

১০. পরিবারে সময় কম দেওয়া।

১১. অন্য সময় যৌন সংক্রান্ত জল্পনা-কল্পনায় লিপ্ত থাকা।

কম্পালসিভ সেক্সচুয়াল বিহেভিয়ার এটাকে বাধ্যতামূলক যৌনাচারও বলা যেতে পারে। যৌনাসক্তি থেকে পার্থক্য হলো এখানে যৌন বিষয়ে আগাম কোনো জল্পনা-কল্পনা থাকে না। তবে তীব্র একটা যৌন আকাঙ্খা আসে। এই আকাঙ্খাকে সে উপেক্ষা করতে পারে না। এর লক্ষণগুলো হলো-

১. অর্থের বিনিময়ে সেক্স করা।

২. অতিরিক্ত পর্নোগ্রাফি দেখা।

৩. ফোনসেক্স, সাইবার সেক্স, ডেটিং, অ্যাপস ব্যবহার করা।

৪. দাম্পত্য সম্পর্কে আগ্রহ কমে যাওয়া।

৫. পরিবারে সময় কম দেওয়া।

মানসিক কারণে যৌনতার ওপর নির্ভরতা

যৌন আবেগ এমন একটি আবেগ যা আমাদের দুশ্চিন্তা থেকে বিষণ্ণতা থেকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও মুক্তি দিতে পারে। বিশেষ করে যারা দুশ্চিন্তাপ্রবণ, যাদের মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতা কম তারা রিলাক্সের জন্য অনেক সময় যৌনতার দিকে ঝোঁকে। তাঁদের মধ্যে লক্ষণীয় প্রবণতাগুলো হলো-

১. বারবার যৌন কাজে লিপ্ত হওয়া।

২. পর্নোগ্রাফি দেখে রিলাক্স বোধ করা।

৩. স্ট্রেস কমানোর জন্য হস্তমৈথুন করা বা যৌন মিলন করা।

যদিও সমস্যগুলো বেশির ভাগ সময় চাপা পড়ে থাকে। লোকলজ্জার ভয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া হয় না। তবে স্বস্তির কথা হলো এই যে, এর চিকিৎসা আছে।

মনের অবস্থাকে নির্ধারণ করে, সেই অবস্থা তৈরি হওয়ারে পেছনে যথাযথ কারণ বিশ্লেষণ করে চিকিৎসা করা যায়। জনসংখ্যার শতকরা ৫% থেকে ৬% মানুষ এ ধরনের সমস্যায় ভুগছেন। অনেকে হয়ত সমস্যাই মনে করছেন না।

আবার অনেকে অসহায় বোধ করে কষ্ট পাচ্ছেন। ওষুধ এবং মনোচিকিৎসা উভয়ের সমন্বয়েই এই ধরনের রোগের চিকিৎসা করা হয়।

যৌক্তিক অযৌক্তিকের প্রশ্ন না তুলে জীবনকে আরো সুন্দর করে উপভোগ করার জন্য আপনার সদিচ্ছাই যথেষ্ট।

ডা. এস এম আতিকুর রহমান

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleপিটিএসডি: অতীতের পীড়ায় বর্তমানে মানসিক আঘাত
Next articleস্বপ্ন দেখি মনের মতো কাজ করার: রওনক হাসান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here