মানুষ ও চিন্তা-শক্তি

ডা. মুনতাসীর মারুফ

এক অর্থে মানুষ মাত্রই চিন্তাবিদ এবং এই বিদ্যা শুধু অর্জনের জন্য মানুষকে তেমন একটা বেগ পেতে হয় না। কেবল স্বাভাবিক মনুষ্য জীব হিসেবে জন্মানো আর বেড়ে ওঠাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাদের চিন্তা-শক্তির অধিকারী করে তোলে।

তবে চিন্তাস্রোত সঠিক ধারায় প্রবাহিত করতে এবং যৌক্তিক চিন্তক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে ব্যাপক চিন্তা ও পরিশ্রম প্রয়োজন। বিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের মনে নিয়তই চিন্তারা আনাগোনা করে। চিন্তাহীন অবসর নেই মানব-মনের।

যখন চুপচাপ শুয়ে-বসে থাকি, তখন তো চিন্তামগ্ন থাকিই অন্যের সঙ্গে কথা বলার সময়, অন্যের কথা শোনার সময়, কোনো কাজ করার সময়ও আমাদের মন চিন্তাশীল থাকে। এমনকি যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি তখনো নাকি চিন্তারা ঘুরে বেড়ায় মাথার ভেতরে, মনের গভীরে এমনও তত্ত্ব রয়েছে।

চিন্তাধারার গতি-প্রকৃতিও অচিন্তনীয়! গবেষণায় দেখা গেছে, কথা বলার সময় মানুষ প্রতি মিনিটে গড়ে ১৫০-২০০ শব্দ উচ্চারণ করতে পারে, পড়তে পারে গড়ে প্রতি মিনিটে ২০০-৪০০ শব্দ। কিন্তু একই সময়ে চিন্তা করতে পারে ১৩০০-১৮০০ শব্দ।

জন্মসূত্রে প্রাপ্ত এই শক্তি বা ক্ষমতাই মানুষকে মানুষ করে তোলে; প্রাণ আছে এমন সকল জীব থেকে আলাদা, উচ্চতর অবস্থানে অধিষ্ঠিত করে। জীবিকা নির্বাহের প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে, আমরা সকলেই চিন্তাজীবী। চিন্তা-শক্তিই আমাদের বেঁচে থাকা, জীবিকা-অর্জনের প্রাথমিক অস্ত্র।

সেই আদি-যুগের গুহামানবই হোক, সভ্যতার উৎকর্ষতার দাবিদার এই একবিংশ শতকের উত্তরাধনিক মানুষই হোক, তার অস্তিত্ব নির্ভর করে চিন্তাসূত্রের মাধ্যমে সঠিক পরিকল্পনার ওপর। মানুষ জন্মসূত্রে সকল জ্ঞান প্রাপ্ত হয় না। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জগৎ সংসার পারিপাশ্বির্কতার ব্যাপারে সে জ্ঞানার্জন করে।

কোনটা সঠিক, কোনটা সঠিক নয় বুঝতে পারে। বন্ধু-শত্রু, বিপদ-নিরাপত্তা, প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের পার্থক্য করতে পারে। এই যে জ্ঞান, এই যে বোধগম্যতা, সেটি মানুষ অর্জন করে তার চিন্তাশক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে। এই জ্ঞান কাজে লাগিয়েই মানুষ তার ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করে।

প্রতিটি মুহূর্তে চিন্তার প্রয়োজনীয়তা আমরা অনুধাবন করতে পারি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সারাদিন কী করব, না করব সে ব্যাপারে চিন্তিত থাকি। কারো সঙ্গে কথা বলতে গেলে কী কথা কীভাবে বলব, তা চিন্তা করে নিতে হয়।

কোনো কাজ করতে পরিকল্পনা করতে হয়। কাজ জটিল হলে তো চিন্তা করতে করতে চিন্তা-জ্বরই চলে আসে। খেতে গেলে কী খাব, কী খাব না, কী খেলে কী সমস্যা হতে পারে, তা ভেবে চিন্তাকুল হই। আমার আচরণ বা কাজে অন্যের ওপর কী প্রভাব পড়বে, তাও চিন্তাযোগ্য। চিন্তাবিমুখ ব্যক্তির কাজে ভুল বা বিপর্যয়ের সম্ভাবনা বেশি থাকে। সে কারণেই প্রবাদ আছে ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।

অবাধ তথ্য (এবং অ-তথ্য, অর্ধ-তথ্য, কু-তথ্য, ঘোরানো তথ্য ও মোড়ানো তথ্য)- প্রবাহের এই যুগে চিন্তা-ক্ষমতা সত্য আর মিথ্যার, কল্পকাহিনি আর বাস্তবতার পার্থক্য বোঝার জন্যও অবশ্য-প্রয়োজনীয়।

তর্কসাপেক্ষে এটিই মানব-সভ্যতার জন্য বর্তমানে অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জ। মুঠোফোনে আঙ্গুল স্পর্শে বা কণ্ঠ-নির্দেশে অথবা ব্যক্তির নিতান্ত অনিচ্ছাতেও অসংখ্য-অজস্র তথ্য হাজির হয় চোখের সামনে, মনের দ্বারে।

দ্বার খোলা রেখেই ভ্রমটাকে রুখে সত্যটাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া, বাস্তবতাটা হৃদয়ঙ্গম করা নির্ভর করবে মানুষের যৌক্তিক ও বিশ্লেষণী চিন্তার গভীরতার ওপর।

আমাদের আবেগ নির্ভর করে আমাদের চিন্তার ওপর। কোনো নির্দিষ্ট ঘটনায় আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা কেবল ঐ ঘটনার ওপর নির্ভর করে না। আমাদের চিন্তা এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। আমি কাউকে ফোন করলাম। কলটা অপরপ্রান্ত থেকে রিসিভ হলো না।

ঘটনা এটকু ই আমার ফোনটি রিসিভ হয়নি। এতে আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বা আবেগ কী হবে, আমি রেগে যাব, দুঃখিত হবো, ব্যথিত না উদ্বিগ্ন হবো, কিংবা একদম স্বাভাবিক থাকব তা নির্ভর করবে আমার চিন্তার ধরনের ওপর।

আমি যদি চিন্তা করি, ফোন রিসিভ না করে অপর প্রান্তের মানুষটি আমাকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে বা আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না, আমি ব্যথিত হতে পারি বা রেগে যেতে পারি। যদি ভাবি, নিশ্চয়ই সে কোনো বিপদে পড়েছে অথবা তার ফোনটা চুরি হয়ে গেছে তাহলে আমি উদ্বিগ্ন হতে পারি।

আর যদি চিন্তাটা এভাবে করি যে, সে হয়ত কোনো কাজে ব্যস্ত বা মুঠোফোনটি শব্দহীন অথবা ফোনের কাছে সে নেই; যখন মিসড কল দেখবে, তখন তো রিং ব্যাক করবেই সেক্ষেত্রে আমার আবেগ-সমদ্র হয়ত স্থিরই থাকবে, তাতে উথাল-পাথাল ঢেউ উঠে আমার স্বাভাবিক অন্যান্য কাজ ব্যাহত করবে না।

পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করবে আমার চিন্তার প্রকতির ওপর। শুধু ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেই নয়, সামগ্রিক মানব-সভ্যতা বিকাশের নেপথ্যেই রয়েছে মানুষের এই চিন্তা প্রবণতার সঠিক ব্যবহার।

আদি-মানবের আগুনের আবিষ্কার থেকে শুরু করে, গুটেনবার্গের প্রিন্টিং প্রেস, টমাস আলভা এডিসনের বিদ্যুৎ, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের টেলিফোন, আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের পেনিসিলিন, রাইট-ভ্রাতৃদ্বয়ের উড়োজাহাজ, হালের লরেন্স রবার্টসসহ অন্যান্যদের অবদানের ইন্টারনেট, এমনকি সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের টিকা সকল আবিষ্কারের পেছনেই রয়েছে মানুষের চিন্তা-শক্তি।

মানুষের চিন্তাই জন্ম দিয়েছে এবং বিকশিত করেছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানান ধারা। শিল্প-সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীত-নৃত্য, নাটক-চলচ্চিত্র, ক্রীড়া সকল ক্ষেত্র মানুষের সৃষ্টিশীল চিন্তার অবদান। আপনার-আমার চিন্তনের এই শক্তি যদি না থাকত? কী একটা চিন্তাতীত ব্যাপার হতো সেটা চিন্তা করতে গেলেই তো চিন্তা-বিভ্রম ঘটে!

ডা. মুনতাসীর মারুফ

সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleশিশুকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করতে করণীয়
Next articleবয়সন্ধিকালে অতিরিক্ত হস্তমৈথুন ও করণীয়
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here