পরিবর্তন প্রয়োজন মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতায়

আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রায় নেই বললেই চলে। দেশের মানুষ এখনো নিজের মানসিক সমস্যার কথা বলতে সংকোচবোধ করে। কিন্ত, অন্য শারীরিক রোগের মতোই মানসিক রোগের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। যদিও উন্নত বিশ্বে এখন মানসিক রোগ নিয়ে সচেতনতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে, কিন্তু আমাদের দেশে এখনও মানসিক রোগ নিয়ে জনমানুষের সচেতনতার তেমন বৃদ্ধি ঘটেনিঅনেক ক্ষেত্রে যেখানে মনোবিদ্যা বা মনোরোগ চিকিৎসার ব্যাপার আসে, দেখা যায় অনেক ভুল উপস্থাপনা কিংবা ভুল ধারণার রূপায়ন। এসবের পিছনে ভিত্তি হিসেবে থাকে -আপাত সত্য বা অর্ধ প্রমাণিত কোন একটি বিষয়, অথবা আগে প্রচলিত ছিল কিন্তু এখন নেই এমন কোন বিষয়, এমনকি সম্পূর্ণ মনগড়া বা সমাজে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা।

বিশিষ্ট সমালোচকের দৃষ্টিতে নয়, কিছুটা মজা করার ইচ্ছে নিয়েই আসুন দেখে নিই – মানসিক রোগ ও তার চিকিৎসা নিয়ে কি কি ভুল সাহিত্যে বা চলচ্চিত্রে সাধারণত হয়ে থাকে –

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী (মনোরোগ চিকিৎসক) নিজেই আধা পাগল!

মনোরোগ চিকিৎসক কোন পাগলামি করেন না, কিংবা আবোল-তাবোল বকেন না, কিংবা উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা করেন না –এমন কোন চরিত্র সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া রীতিমত দুষ্কর। সাধারণ মানুষের মনে কবি বললেই যেমন ঝোলা কাঁধে একটা উদাসী পথিকের ছবি ভেসে উঠে, তেমনি মনোরোগ চিকিৎসক হিসেবে আধা-পাগল একজন মানুষকেই সার্থকভাবে গণ-মানুষের মনে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন শিল্পী-সাহিত্যিকরা। আসলে, প্রত্যেক মানুষেরই কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে- যেসব তাকে অন্যদের কাছে পছন্দের বা অপছন্দের করে তোলে। কিন্তু, একজন মনোরোগ চিকিৎসক যেহেতু সাধারণের ভাষায় ‘পাগল’-দের চিকিৎসা করেন, তাই তাঁর এইসব আচরণকেও পাগলামি হিসেবে ভাবতেই সবাই ভালবাসে। আর সাহিত্যিকরাও এই ব্যপারটাকে নিয়ে মজা করতেই ভালবাসেন।

মানসিক রোগের চিকিৎসক গোয়েন্দা!

বিভিন্ন উপন্যাসে, চলচ্চিত্রে দেখা যায়, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে রোগী কোন জটিল সমস্যা নিয়ে এসেছেন, আর চিকিৎসক সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বা অন্য কিছু করতে করতে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছেন। এরপর তিনি নিজেই নেমে পড়েন মাঠে, রোগীকে আড়ালে অনুসরণ করেন, বা রোগীর বিভিন্ন কথা বিশ্লেষণ করেন, বিভিন্ন আত্মীয় বা বন্ধুর কাছ থেকে তথ্য জোগাড় করেন – এককথায় রীতিমত গোয়েন্দাকে হার মানিয়ে সমস্যার সমাধান করে ফেলেন, সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেন, এমনকি কোন লুকিয়ে থাকা অপরাধীকে আইনের হাতে তুলেও দেন।

থ্রিলারধর্মী উপন্যাস বা চলচ্চিত্র হিসেবে ব্যাপারটা খুবই উপভোগ্য, কিন্তু আসলে সে রকম কিছু কি হয়?

ভালোবাসার অভিনয় করতে গিয়ে ভালবাসা

গল্পের বা নাটকের বা সিনেমার নায়ক বা নায়িকা ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে আজ বদ্ধ উন্মাদ, তার মা-বাবা- দাদি শোকে কাতর, কি করবেন ভেবে দিশেহারা। বিখ্যাত ডাক্তার অমল বোস আসলেন রোগী বা রোগিণীকে দেখতে, দেখা শেষে গম্ভীর মুখে জানালেন সমাধান- এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে, যে মন-প্রাণ উজাড় করে তাকে ভালবাসবে, ভুলিয়ে দিবে অতীত স্মৃতি। এটাই একমাত্র চিকিৎসা-আর কোন উপায় নেই। এরপরের ঘটনা সবার জানা। অনেক সময় চিকিৎসক তরুণ বয়সের হলে দায়িত্বটা নিজেই নিজের কাঁধে তুলে নেন। সমস্যা হচ্ছে, একজন চিকিৎসক সারা জীবনে শুধু একবারই এমন সেবা দিতে পারবেন, বারবার করতে গেলে কি হবে তা সহজেই অনুমেয়।

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে বৈদ্যুতিক শক

সালমান খান অভিনীত ‘তেরে নাম’ সিনেমায় দেখা গেল-তার পাগলামির জন্য, বোকামির জন্য বা কোন নির্দেশ মানতে না চাওয়ার জন্য একটাই সমাধান, উচ্চমাত্রার বৈদ্যুতিক শক। তাকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় একটা কক্ষে, মাথায়-পায়ে-হাতে লোহার বেড়ি পড়িয়ে দেয়া হয়- তারপর কাচের ওপারে থেকে একটা মেশিনে নব ঘুরিয়ে শক দেয়া হয়, প্রায় ৫/৬ মিনিট ধরে এক চিকিৎসক ইচ্ছে করেই বেশিমাত্রার বৈদ্যুতিক শক দিতেই থাকেন এবং মাত্রাটাও বাড়াতে থাকেন ইচ্ছেমত। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার! সত্যিকার অর্থে, পুরানা চিকিৎসা পদ্ধতি Electroconvulsive Therapyর উপর ভিত্তি করে এসব দেখানো হয়।

কিন্তু এখন আর এসবের প্রচলন নেই, আর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও দুর্বল। তবে কোন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করাও হয়, তার আগে অনেক সতর্কতা, পরীক্ষা নিরীক্ষার পর, রোগীকে অজ্ঞান করে মাত্র ১/২ সেকেন্ডের জন্য দেয়া হয়।

মাথায় আঘাত

উপমহাদেশের, বিশেষ করে বাংলা ছায়াছবিতে এর উপস্থাপন অহরহ। স্মৃতি হারিয়ে ফেলার কারণ হিসেবে এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা গেলেও, মাঝে মধ্যে পাগল হয়ে যাবার ঘটনা হিসেবে দেখা যায়।

ব্যাপারটা এত সাধারণ হয়ে গেছে যে, এখন পাঁচ-ছয় বছরের শিশুও বলে দিতে পারে, সুস্থ হয়ে উঠার একটাই উপায়- আবার মাথায় বাড়ি।

মানসিক রোগের চিকিৎসা ( সম্মোহন পদ্ধতি)

‘আজ রবিবার’ নাটকটির কথা আশা করি অনেকেরই মনে আছে। সেখানে জাহিদ হাসানকে সুস্থ করে তোলা হয় সম্মোহন পদ্ধতির মাধ্যমে। শুধু এখানেই নয়- অনেক উপন্যাসে, নাটকে, গল্পেই দেখানো হয়; মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সম্মোহন করার জিনিষপত্র নিয়েই ঘোরাঘুরি করেন- আর লোক দেখলেই একটা দোলক দোলাতে দোলাতে বলতে থাকেন- আপনি এখন ঘুমিয়ে পড়বেন, আপনার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে।

কিন্তু, চেনাজানা কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কী এই আচরণ করেন? করবেনই বা কেন? এসব সম্মোহন পদ্ধতি এখন আর কেউই ব্যবহার করেন না। আসলে, এর সাথে একটু রহস্যময়তা, গা শিউরে ওঠার সম্পর্ক আছে দেখেই- এর এত ব্যবহার।

টাকা খোর চিকিৎসক

খলনায়ক কোন ভাবেই পাচ্ছেনা নায়িকার মন, কিংবা ছোটভাই হাত করতে চায় সকল সম্পত্তি- উপায় কি? উপায় আছে- হাত করতে হবে টাকাখোর অমানুষ এক মনোরোগ চিকিৎসককে। আর তারপর তার ক্লিনিকে ভর্তি করে দাও নায়ককে, অথবা বড়ভাইকে। ব্যস, কেল্লা ফতে। ওখানে, চিকিৎসকের নেতৃত্বে বন্দি লোকটাকে পর্যায়ক্রমে মারধর, বৈদ্যুতিক শক দেয়া হবে। আর সবশেষে একটা বিশাল বড় ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ নিয়ে আসা হবে-যাতে ভর্তি করা আছে অব্যর্থ ‘পাগল’ বানানোর ওষুধ। ভাগ্য ভালো থাকলে, দেয়াল ভেঙ্গে কেউ উদ্ধার করে নিয়ে যায় বন্দিকে, আর খারাপ হলে –‘পাগল’।

ব্যাপারটাতে, কিছু সত্যতা যে নেই তা নয়। তবে, যত সহজে এ ঘটনা ঘটতে দেখানো হয়, তত সহজ নয় বাস্তবে। এখানে মনে রাখা দরকার, আমাদের দেশে অনেক ধরণের ভুয়া মানসিক রোগের চিকিৎসক নামধারী ব্যক্তি, বেআইনি ভাবে মানসিক রোগের ভুয়া চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। যাদের কারো কারো আবার নিজস্ব ‘পাগলা গারদ’ ও আছে। সেসব ক্ষেত্রে এসব হওয়া সহজ হলেও হতে পারে। কিন্তু, কোন সরকারী হাসপাতালে কিংবা আদালতে কাউকে মানসিক রোগী বা অপ্রকৃতস্থ (পাগল বলে কোন শব্দ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের অভিধানে এখন আর নেই) হিসেবে ঘোষণা করতে হলে, কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়, কারো একক সিদ্ধান্তে তা হয়না। আর, কারো অনুরোধে বা অবৈধ ঘুষের মাধ্যমে একজন রোগীকে নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত সময় হাসপাতালে রাখা যায় না। আর একটি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমেই একজনকে সম্পূর্ণ ‘পাগল’ বানানো আগের দিনে রূপকথায় সম্ভব হলেও আধুনিক কোন ওষুধের মাধ্যমে তা সম্ভব নয়।

এসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা করার কিংবা উচিৎ-অনুচিত ঠিক করে দেয়ার কোন উদ্দেশ্যই এই লেখার কারণ নয়। এই লেখার বক্তব্য একটাই- একদিনের রাজা বানাতে চাইলে সম্রাট হুমায়ুনের কাছ থেকে ধার না করে, বর্তমান পদ্ধতির মধ্যেই গ্রহণযোগ্য কোন ধারণা তৈরি করাটাই শক্তিমান সাহিত্যিকের কাজ। গতানুগতিকতা থেকে বের হয়ে নতুন কিছু তৈরি হলেই বেশি উপভোগ্য হয় ব্যাপারটা। যেমন -সত্যজিৎ রায়ের ‘বাক্স বদল’ ছায়াছবিটি সেই সময়ের তুলনায় আধুনিক হলেও বর্তমান সময়ের বিবেচনায় বাস্তবসম্মত নয়। পক্ষান্তরে, উল্লেখ করা যায় “ভুল ভুলাইয়া”, “Shutter Island”, “Inception” –এমনই সব ছবির কথা, যেখানে অবাস্তব ও বাস্তব কি সুন্দরভাবে মিশে যায়, যুক্তির সীমা ছাড়িয়ে।

“সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর”-এর মতো বাস্তবতা ও বৈজ্ঞানিক ধারণাকে ধারণ করেই তৈরি হোক অসাধারণ কাহিনি, উপন্যাস, ছায়াছবি, নাটক- এটাই শেষ প্রত্যাশা। ভুলে গেলে চলবে না, সচেতনতা তৈরিতে এসবের চেয়ে শক্তিশালী দ্বিতীয় কোন মাধ্যম নেই।

Previous articleঅ্যাম্বুলেন্স নেই জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের
Next articleমানসিক রোগ নিরাময়ে প্রয়োজন জনসচেতনতা
ডা. পঞ্চানন আচার্য্য। স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রাম। তবে, কলেজ শিক্ষক মায়ের চাকুরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কেটেছে শৈশব। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবং উচ্চ-মাধ্যমিক চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। সিলেট এম. এ. জি. ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাসের পর সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। মেডিক্যালে পড়ার সময় থেকেই মনোরোগ নিয়ে পড়ার প্রতি আগ্রহ। তাই, ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্ধারিত সময়ের চাকুরি শেষে ভর্তি হন মনোরোগবিদ্যায় এম.ডি(রেসিডেন্সি) কোর্সে। বর্তমানে তিনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত শিক্ষকতার ধারা বজায় রেখে চিকিৎসক ও শিক্ষক হওয়াটাই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। বই, সঙ্গীত আর লেখালেখিতেই কাটে অবসর সময়ের বেশির ভাগ। স্বপ্ন দেখেন - মেধা ও মননশীলতার চর্চায় অগ্রগামী একটা বাংলাদেশের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here