মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় নার্সের ভূমিকা

মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় নার্সের ভূমিকা

বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় ২ কোটি মানষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। শতকরা হিসেবে বলা যায় প্রতি ১০০ জনে ১৬ জনের মতো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছেন। শিশুদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যাটা আরেকটু বেশি, প্রায় ১৮.৪ শতাংশ।

অন্যদিকে এই বিপলসংখ্যক মানসিক রোগীর জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন মাত্র ৩০০ জনেরও কম। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষিত নার্স রয়েছেন ১২ হাজারের মতো। এই সংখ্যাগুলো দেখে যে কেউই বলবেন এত অল্প সংখ্যক চিকিৎসক এবং সেবিকা দিয়ে গোটা দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়াটা যারপরনাই কঠিন, কষ্টসাধ্য এবং প্রায় অসম্ভব একটা বিষয়।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে মানসিক রোগের চিকিৎসা শুধু সাইকিয়াট্রিস্টের একার দায়িত্ব নয়, বাস্তবিক পক্ষে তা সম্ভবও নয়। এজন্য চাই হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ বা সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এই গ্রুপে সাইকিয়াট্রিস্ট থাকবেন প্রধান কিন্তু পাশাপাশি থাকবেন সাইকোলজিস্ট, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নার্স, সোশ্যাল ওয়ার্কার এবং অকপেশনাল থেরাপিস্ট।

এখানে একটা বিষয় খুবই লক্ষণীয় সবার মধ্যে নার্স বা সেবিকাগণ সব থেকে বেশি সময় রোগীর সন্নিকটে বা সংস্পর্শে থাকেন। বিশেষ করে ভর্তিকৃত রোগীর ক্ষেত্রে। প্রকৃতপক্ষে ২৪ ঘণ্টাই তারা ভর্তিকৃত রোগীর দেখভাল করেন। শুধু ঔষধ খাওয়ানোই কিন্তু তাদের একমাত্র কাজ নয় বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর ব্যক্তিগত কাজ যেমনÑবাথরুমে নিয়ে যাওয়া, খাবার খাইয়ে দেয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রেও যথেষ্ট ভমিকা পালন করেন।

ইদানীং ট্রেইন্ড নার্সগণ প্রয়োজনে রোগীর বাড়ি গিয়েও সেবা প্রদান ও চিকিৎসা কাজে সহায়তা করেন। যেমন: যে রোগীর ইনজেকশন প্রয়োজন কিন্তু হাসপাতালে আসতে পারছেন না প্রয়োজনে বাড়ি গিয়েও তাকে প্রয়োজনীয় ঔষধ গ্রহণের সাহায্য করেন এই সেবিকাগণ।

সুতরাং সাইকিয়াট্রি তথা মেডিক্যাল সেক্টরে তাদের অবদান অপরিসীম এবং অনস্বীকার্য একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন বিষয়টি হলো মানসিক রোগীদের জন্য নার্সদের এই সেবা প্রদানকে কীভাবে আরো সন্দর এবং যুগোপযোগী করা যায় সেই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। এটি বাস্তবায়নের জন্য নিচে কতগুলো বিষয়ের অবতারণা করা হলো:

প্রথমত: নার্স বা সেবিকাগণের এই সেবা প্রদান

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বিষয়টাকে আমাদের সমাজের সর্বস্তরে সকলকে মূল্যায়ন করতে হবে এবং তাদের অবদান যে অনস্বীকার্য এই কথাটা অকপটে স্বীকার করতেই হবে। পাশাপাশি এই পেশাতে শিক্ষিত ও মেধাবীদের আসার জন্য উৎসাহ দিতে হবে। এজন্য দরকার ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা।

দ্বিতীয়ত: মানসিক রোগ সম্পর্কে নার্সদের যথেষ্ট পরিমাণে জ্ঞান থাকতে হবে। এই বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপর্ণ এবং খানিকটা কঠিনও বটে। এক্ষেত্রে আমাদের চিকিৎসক বিশেষ করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।

এখন সময় এসেছে, আমাদেরকে ভাবতে হবে নার্সিং কোর্স কারিকলাম নিয়ে। সাইকিয়াট্রির সকল বেসিক বিষয়গুলো সহজে সাবলীল ভাষায় এবং যুগোপযোগী করে উপস্থাপন করতে হবে। প্রয়োজনে বোঝার সুবিধার্থে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাতে কিছু কিছু বই প্রকাশ করা যেতে পারে। বিশেষ করে psychotropic drugs সম্বন্ধে খুবই ভালো জ্ঞান থাকতে হবে।

মানসিক রোগ সম্বন্ধে সমাজে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর করতে হবে। মানসিক রোগ যে অন্যান্য শারীরিক রোগের মতোই একটা রোগ এবং এর বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা রয়েছে এটা তাদেরকে খুব পরিষ্কারভাবে বুঝাতে হবে।

সঙ্গে সঙ্গে এটা বোঝাও জরুরি যে বেশির ভাগ মানসিক রোগের জন্য কোনো একটা বিষয় এককভাবে দায়ী নয় বরং multifacto বা অনেকগুলো বিষয় একসঙ্গে জড়িত। যেমন: বংশগত কারণ, জৈবিক কারণ, পরিবেশগত কারণ, সামাজিক কারণ ইত্যাদি। সবার প্রথমে এই বিষয়টিকে পরিষ্কারভাবে বঝতে হবে।

প্রয়োজনে কমিউনিটিতে বিভিন্ন সভা সমাবেশ করে নার্সদেরকে এই বিষয়ে বলার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। বিশেষ করে উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে কাজটা করা গেলে সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি থাকে। এখানে সেবিকাগণ মানসিক রোগীর সেবা প্রদান সংক্রান্ত তাদের অভিজ্ঞতা জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারেন।

তৃতীয়ত: হাসপাতালে বিশেষ করে যেখানে মানসিক রোগীদের জন্য ইনডোর রয়েছে সেখানে ডাক্তারদের রাউন্ডে নার্সদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে করে অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ের স্যারদের কাছ থেকে সরাসরি শেখার সুযোগ থাকে। প্রয়োজনে জানার জন্য তারা সম্মানিত শিক্ষককে সরাসরি প্রশ্ন করতে পারবেন এমন ব্যবস্থা রাখা উচিত।

হাসপাতালে সাইকিয়াট্রিতে যে সমস্ত ট্রেইনি ডাক্তার অথবা জুনিয়র ডাক্তারগণ থাকেন তাদেরকে সরাসরি নার্সদের ক্লাস নেয়ার শিক্ষা কার্যক্রমে সরাসরি সম্পক্ত করা উচিত। এটার একটি ভালো দিক হলো যেহেত জুনিয়র ডাক্তাররা প্রতিদিন রোগীর ফলোআপ করেন, ফলে প্রতিটি রোগী সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা থাকে। পাশাপাশি অধ্যাপকবন্দের চেয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে কোনো কিছু জানতে চাওয়াটা নার্সদের জন্য বেশি সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়।

চতুর্থত: মানসিক রোগের জন্য বড় বড় যেসব হাসপাতাল রয়েছে যেমনÑ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, মেন্টাল হাসপাতাল পাবনা, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ইত্যাদি হাসপাতলে প্রতি মাসে মানসিক রোগীদের সেবা প্রদানের জন্য Best nurse of the month বা এ জাতীয় কিছু awards চালু করা যেতে পারে।

ছোট পরিসরে হলেও অনুষ্ঠান করে সবার সামনে বিভাগীয় প্রধানের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পুরস্কার বা reward কাজের ক্ষেত্রে যে কি ভীষণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলে তা সাইকিয়াট্রিস্টসহ আমরা সবাই জানি। এর জন্য যে স্বল্প খরচ হবে তা আমরা ডিপার্টমেন্টের ডাক্তাররাই চাঁদা তুলে ব্যবস্থা করতে পারি।

পঞ্চমত: মানসিক রোগ বিষয়ক বিভিন্ন পত্রিকা পড়ার জন্য নার্সদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে যে সমস্ত ম্যাগাজিনে বা পত্রিকাতে মানসিক রোগ নিয়ে আলোচনা করা হয় সেগুলোও পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা এবং প্রত্যেকটা বড় হাসপাতালে ডাক্তারদের পাশাপাশি নার্সদের রুমে এগুলো পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে পারলে খুবই ভালো হয়।

বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যে অনুষ্ঠানগুলো হয় সেগুলো দেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করা উচিত। কারণ এখানে বাস্তব বিষয়গুলো নিয়ে বাংলা ভাষাতে প্রশ্নোত্তর পর্ব হয়, ফলে বিষয়গুলো বুঝতে খুবই সুবিধা হয়।

মানসিক রোগীর ক্ষেত্রে সেবিকাদের দায়িত্ব কর্তব্য:

এতক্ষণ যে আলোচনা করা হলো তা থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে আমাদের সমাজে মানসিক রোগীর সংখ্যা অনেক এবং সঠিক চিকিৎসা ও সেবা পেলে এই রোগীরা সুস্থ হয়ে সমাজের একজন কর্মক্ষম ব্যক্তিতে পরিণত হবে। আর তাদের সুস্থতার জন্য নার্সদের গুরুত্ব অপরিসীম।

এখন জানা দরকার সেবিকাদের কী কী দায়িত্ব রয়েছে। সেবিকাদের সবার আগে যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে তাহলো মানসিক রোগীও মানুষ এবং তাদেরও নিজের অনুভূতি প্রকাশের ক্ষমতা আছে, পছন্দ-অপছন্দ আছে এবং আছে আত্মসম্মানবোধ।

সবসময় মনে রাখবেন, মানসিক রোগীও নিজেকে দায়িত্বশীল ও সম্মানিত ব্যক্তি বলে মনে করেন এবং অপরের কাছে তা আশা করে। সে চায় সবার মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা। অতএব একজন পরিপূর্ণ মানুষের মতো তার প্রতি আপনার ব্যবহার হওয়া উচিত। কারণ সে মানসিক রোগে ভুগছেন। আপনি তাকে বুঝতে চেষ্টা করুন এবং তার প্রতি সদয় ব্যবহার করুন। তাকে ছোট ভাববেন না বা কোনো রকম করুণা প্রদর্শন করবেন না।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে এত এত কাজের মাঝে সেবিকাগণ কোন কোন কাজকে অগ্রাধিকার দেবেন। নিচে সেই বিষয়টি নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আলোচনা করা হলো।

নিয়মিত স্বাস্থ্য সেবাদান কার্যক্রমের পাশাপাশি সেবিকাগণ নিম্নলিখিত কাজগুলোও করবেন:

আপনাদের আশেপাশে যারা মানসিক রোগী আছেন তাদেরকে শনাক্ত করুন এবং নিকটবর্তী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা জেলা সদর হাসপাতাল কিংবা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মানসিক রোগ বিভাগে প্রেরণ করুন। যদি এসব জায়গায় পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকে তাহলে কোনো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে বলুন। যদি এগুলোর কোনোটাই সম্ভব না হয় তাহলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় অথবা মানসিক হাসপাতাল পাবনাতে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দিন।

এইসব রোগীদের নিয়মিত ফলোআপে সহায়তা করুন। পাশাপাশি রোগীর নিরাপদ ও আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিতে সহযোগিতা করা উচিত।

মানসিক রোগ বিষয়ে আপনারা যে সমস্ত জ্ঞান অর্জন করেছেন তার মাধ্যমে পরিবার ও সমাজের মানুষকে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেষ্টা করুন।

আত্মহত্যার প্রবণতা আছে এমন রোগীকে সার্বক্ষণিক নজরে রাখুন এবং রোগীর ফাইলে লাল কালি দিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা আছে কথাটি লিখে রাখুন। বাথরুমে কোনো রোগী দরজা বন্ধ করে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে কিনা খেয়াল রাখন।

আঘাত করার মতো কোনো জিনিস রোগীর কাছে থাকলে দ্রুত সরিয়ে ফেলুন। ঔষধ সেবন করছে এমন রোগীর pulse এবং Blood pressure নিয়মিত চেক করুন। কোনো রোগী পালিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ড মাস্টারকে অবহিত করুন এবং ফাইলে নোট রাখুন।

রোগী ও রোগীর অভিভাবকদের মানসিক সমর্থন দান করুন। সর্বদা নিজের প্রতি যতœবান হোন, কারণ আপনারা ভালো থাকলে তবেই মানসিক রোগীরা ভালো থাকবেন। সবসময় মনে রাখবেন আপনারা একটা মহান পেশায় এসেছেন, এই মহান পেশার মর্যাদা রক্ষা করার দায়িত্বও আপনাদেরই। আপনাদের কাজের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে আপনারা মানুষের দোয়া ও ভালোবাসা পেয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও পাবেন।

ডা. মো. সুলতান ই মনজুর

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ

সূত্র: মনের খবর, মাসিক ম্যাগাজিন

Previous articleমানসিক রোগ চিকিৎসা পদ্ধতিগত পার্থক্য
Next articleবয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের মানসিক পরিবর্তন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here