মানসিক রোগের ওষুধ নিয়ে বিভ্রান্তি

অজ্ঞতা অসচেতনতা আর কুসংস্কারের ফলে মানসিক রোগ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই স্বীকার করতে চান না অনেকে। গায়েবী আওয়াজ শোনা, ভ্রান্ত কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস, অহেতুক সন্দেহ, আচার-আচরণ বা কথাবার্তার অস্বাভাবিক পরিবর্তন, কনভার্সন ডিজঅর্ডার (যা হিস্টিরিয়া বা মূর্ছা রোগ নামেই বেশি পরিচিত)- এর উপসর্গগুলোকে জ্বীন-ভূতের আছর, জাদু-টোনা, তাবিজ, আলগা বাতাসের প্রভাব বলেই বিশ্বাস করেন অনেকে। আত্মীয় স্বজন এসব সমস্যায় আক্রান্ত হলে তারা চিকিৎসাও করান তেল পড়া, পানি পড়া, তাবিজ, ঝাড়-ফুঁক, ‘শিকল থেরাপি’ ইত্যাদির মাধ্যমে।

অনেকের কাছে মানসিক রোগের উপসর্গগুলো বয়সের দোষ, বিয়ের জন্য টাল-বাহানা, ঢং বা ভং ধরা। চিকিৎসার ব্যাপারে এদের বিশ্বাস- ‘মাইরের উপর ওষুধ নাই।’ কখনও কখনও শারীরিক উপসর্গ যে মানসিক রোগের কারণে হতে পারে তাও অনেকে মানতে চান না। ফলে, মানসিক সমস্যার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে শারীরিক উপসর্গ নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকেন তারা।

এসব কুসংস্কার ও অজ্ঞতার বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে যারা মানসিক রোগ চিকিৎসার আওতায় আসেন, তাদেরও বড় একটা অংশ ওষুধ নিয়ে নানা বিভ্রান্তিতে সঠিক চিকিৎসা করান না। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে মানসিক রোগ চিকিৎসার আধুনিক ওষুধ আবিষ্কৃত হয়। এরপর সময়ের গতির সাথে মানসিক রোগ চিকিৎসার অগ্রগতি সাধিত হয়, আবিষ্কৃত হয় নতুন নতুন ওষুধ, সেসব ওষুধের সফল প্রয়োগ মানসিক রোগ নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে মানসিক রোগের ওষুধ সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এখনও বিদ্যমান।

মানসিক রোগের ওষুধের ক্ষেত্রে একটি ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে, এগুলো খেলে ব্রেণের ক্ষতি হয়, ব্রেণ নষ্ট হয়ে যায়, মস্তিষ্ক আর কখনোই স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না ইত্যাদি। অনেকের ধারণা এসব ওষুধ শুধু ঘুম পাড়ায়, আর কোনো কাজে আসে না। সার্বিকভাবে আমাদের দেশ ওষুধ সংক্রান্ত গবেষণা ও নতুন ওষুধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো নাম নয়। উন্নত বিশ্বে, প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন ওষুধ আবিষ্কার ও এর কার্যকরিতা পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেখানকার সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ ওষুধ বাজারজাতকরণের অনুমতি প্রদান করে থাকে।

যেকোনো রোগের চিকিৎসায় নতুন কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হলে তা নির্ধারিত বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে মানবদেহে তা কতটা কার্যকর ও নিরাপদ তা পরীক্ষা করার পরই কেবল কার্যকরিতা ও মানবদেহের নিরাপত্তা বিবেচনায় তা বাজারজাতকরণের অনুমতি দেয়া হয়। তারপরও অব্যাহত থাকে ঐ ওষুধ নিয়ে গবেষণা। এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে নতুন ওষুধ কার্যকর হলেও মানবদেহে এর ক্ষতিকর প্রভাব উপকারের তুলনায় বেশি হওয়ায় বাজারে আর আসেনি। উন্নত বিশ্বে এভাবে অনুমতি প্রাপ্ত ওষুধই উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলো যারা গবেষনায় পিছিয়ে সেসব দেশে ব্যবহৃত হয়। অন্য যেকোনো ওষুধের মতো মানসিক রোগ চিকিৎসার ওষুধের ক্ষেত্রেও একই ধারা অনুসরণ করা হয়। নির্ধারিত গবেষণার ফলাফল সন্তোষজনক হয়ার পরই এসব ওষুধ চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য অনুমতি প্রাপ্ত হয়।

তবে, এ কথা বলা হচ্ছে না যে, মানসিক রোগের ওষুধের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। আবিষ্কৃত কোনো কার্যকর ওষুধই শতভাগ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত নয়। এমনকি আমরা নিয়মিতই মুড়ি মুড়কির মতো যে প্যারাসিটামল আর গ্যাসের ওষুধ (এন্টিআলসারেন্ট) খেয়ে থাকি সেগুলোও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিহীন নয়। মনে রাখতে হবে, একটি ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সব সেবনকারী আক্রান্ত হন না। কোনো কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নগণ্য সংখ্যকের হতে পারে। কিছু সাধারণ, সহনীয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে অনেক সেবনকারীর। কিন্তু এসব প্রতিক্রিয়ার তুলনায় এসব ওষুধের কার্যকর প্রভাবের হার বেশি হওয়ায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশংকাটুকু চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘গ্রহণযোগ্য’ বলেই ধরা হয়। মানসিক রোগের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য। কিন্তু সাধারণভাবে মানসিক রোগ ও এর ওষুধ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক হওয়ায় না জেনেই অনেকে এসব ওষুধ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে থাকেন। অনেকে গবেষণালব্ধ ফল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলেও কেন যেন তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেন না।

মানসিক রোগের ওষুধ দীর্ঘ মেয়াদে সেবনের উপদেশ মেনে চলতে অনেকে দ্বিধাবোধ করেন। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ প্রভৃতির ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে এবং অনেক ক্ষেত্রে আজীবন ওষুধ খাওয়ার জন্য রোগীরা মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন। মৃগী রোগ, বাত জ্বর প্রভৃতি রোগেও কয়েক বছর ওষুধ খাবারের ব্যাপারটিও এখন রোগীরা স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছেন। বিভিন্ন মাধ্যম ও পর্যায়ে দীর্ঘদিনের প্রচারণা, তথ্য সরবরাহ ও শিক্ষার কারণেই এসব রোগের চিকিৎসা ও ওষুধের ব্যাপারে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক। কিন্তু মানসিক রোগের ওষুধ দীর্ঘ মেয়াদে সেবনের ব্যাপারে সমাজের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনও নেতিবাচক। কিছু দিন ওষুধ খাওয়ার পর রোগী যখন ভালো বোধ করেন বা উপসর্গ কমে যায়, তখন রোগী বা তার আত্মীয় স্বজন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেন। ফলে, রোগীর সঠিক চিকিৎসা হয় না। এবং কিছু দিন পর রোগীর উপসর্গ আবার ফিরে আসে। সঠিক প্রচারণা ও কার্যকর তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থার মাধ্যমেই এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন সম্ভব।
monon-600
মানসিক রোগের ওষুধ নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী অনেকে আবার ওষুধ ছাড়া শুধু সাইকোথেরাপী অথবা কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করে দেয়ার দাবী জানান। মানসিক রোগের ধরণ অনুযায়ী ওষুধ, সাইকোথেরাপী ও অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। কোন রোগের জন্য কোন চিকিৎসা প্রয়োজন, তার গবেষণা ভিত্তিক দিক নির্দেশনা রয়েছে। কিছু রোগের চিকিৎসায় যেমন সাইকোথেরাপীই প্রথম পছন্দ আবার সিজোফ্রেনিয়া, ম্যানিয়া, তীব্র বিষণ্নতা সহ আরো কিছু রোগে ওষুধ অপরিহার্য। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ রোগীর রোগ নির্ণয় করে তাঁর জন্য কোন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, সে পরামর্শ দেবেন। মানসিক সমস্যা হলেই যে সাথে সাথে ওষুধ খাওয়া শুরু করতে হবে সেটি যেমন ঠিক নয়- তেমনি সব মানসিক রোগ ওষুধ ছাড়াও ভালো করা যাবে এটিও সত্য নয়। মানসিক রোগের ওষুধ শুরু করতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে, বন্ধও করতে হবে তাঁর পরামর্শ মতো।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleবিষণ্ণতা সম্বন্ধে জানতে হবে
Next articleমাদকাসক্তি একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here