মানবদেহ পরিশ্রম আর বিশ্রামের এক সুস্পষ্ট চক্রে বাধা। এর কোনোটির ঘাটতি বা বাড়তি হলেই বিপত্তি। পরিশ্রমের তুলনায় বিশ্রাম অর্থাৎ ঘুম কম হলে যেমন শরীর ভেঙে যেতে পারে, তেমনি বেশি বিশ্রাম বা ঘুমেও দেখা দিতে পারে নানা সংকট। প্রাপ্ত বয়স্ক প্রায় ত্রিশ শতাংশ মানুষই এ ধরনের ঘুমের সমস্যার শিকার। যার বেশিরভাগই কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় অক্রান্ত।
সম্প্রতি এক মার্কিন গবেষণায় দেখা গেছে, কম ঘুমের ফলস্বরূপ মস্তিষ্কের কোষ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানসিক সমস্যা ও মানসিক রোগ ছাড়াও ঘুমের সমস্যার অন্য কারণগুলোর মধ্যে ঘুমের প্রাথমিক সমস্যা, পরিবেশগত সমস্যা, ও বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা অন্যতম।
ঘুমের সমস্যায় অক্রান্তদের যে শুধু রাতই নষ্ট হয় তাই নয়, বরং তাদের মধ্যে দিনের বেলায়ও অবসাদগ্রস্ততা তথা মেজাজের তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। আবার দীর্ঘ নিদ্রাহীনতার কারণে মানুষের বুদ্ধিমত্তারও ঘাটতি দেখা যায় যা পরবর্তীতে তাঁর ব্যক্তিগত, শিক্ষাগত, পেশাগত ও সামাজিক জীবনে প্রভাব ফেলে।
অনিদ্রার মানসিক কারণ
নিদ্রাহীনতার জন্যে দায়ী মানসিক কারণগুলোর মধ্যে মানসিক চাপ (চাকরিগত সমস্যা, বেকারত্ব, অতিরিক্ত কাজের চাপ, পড়া-লেখার চাপ, বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক কলহ, সম্পর্কের ঘাটতি ইত্যাদি), মানসিক দ্বন্দ্ব বা সিদ্ধান্তহীনতা, দুশ্চিন্তা, বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা, আঘাত পরবর্তী মানসিক চাপ, শুচিবায়ুগ্রস্থতা, আত্মঘাতী মানসিক সমস্যা, নেশাগ্রস্ততা এবং অন্যান্য লঘুতর ও গুরুতর মানসিক রোগ উল্লেখযোগ্য। পরিবেশগত কারণগুলোর মধ্যে রাতের শিফটে কাজ করা, উচ্চ শব্দের মধ্যে বসবাস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
শারীরিক কারণ
শারীরিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে যে কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগ (Chronic disease), শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, স্ট্রোক, হাইপারথাইরয়ডিসম (থাইরয়ড হরমোন বেশি নিঃসরণজনিত সমস্যা), গর্ভধারণ, মেনোপজাল সিনড্রোম, আলজাইমারস্ ডিসিস (বৃদ্ধকালের স্মৃতিভ্রষ্ট রোগ) এবং বিভিন্ন ওষুধের (ক্যাফেইন, এফেড্রিন, কোকেইন, এমফিটামিন, মিথাইলফেনিডেট ইত্যাদি উপাদান সমৃদ্ধ ওষুধ) পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।
সমস্যার ধরণ
ঘুমের সমস্যা মানে যে শুধু ঘুম না হওয়া – ঠিক তা না, ঘুম শেষে অপর্যাপ্ত ঘুমের অনুভূতি কিংবা দিনের বেলাতেও ঘুমঘুম ভাব লাগাটাও এক ধরনের ঘুমের সমস্যা। তবে কারণের তারতম্য অনুযায়ী ঘুমের সমস্যার লক্ষণেরও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। ঘুমের সমস্যা বোঝার প্রধান কয়েকটি লক্ষণ হচ্ছে –
=> ঘুম শুরু হতে দেরি হওয়া বা শোয়ার পরও দীর্ঘ সময় ঘুম না আসা
=> ঘন ঘন ঘুম ভেঙে যাওয়া
=> মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া
=> দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাওয়া
=> ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ করা
=> ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্ট হওয়া
=> ঘুম থেকে উঠেও অপর্যাপ্ত ঘুমের অনুভূতি
=> দৈনন্দিন কাজে বিরক্ত লাগা, মনোযোগ দিতে না পারা অথবা একাগ্রতার অভাব ইত্যাদি।
চিকিৎসা
নিদ্রাহীনতার চিকিৎসার বিষয়ে একজন রোগীর কাছ থেকে প্রথমেই চিকিৎসককে বিস্তারিত ইতিহাস জানতে হবে এবং সব ধরনের শারীরিক ও অন্যান্য পরীক্ষা- নিরীক্ষার মাধ্যমে এর মানসিক কিংবা শারীরিক কারণ নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে হবে।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে ঘুমের ওষুধের পাশাপাশি ঘুমের পরিচ্ছন্নতা (Sleep hygiene) মেনে চলার নির্দেশনা এবং প্রয়োজনে কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। তবে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঘুমের ওষুধ খাওয়া উচিৎ নয়। এর ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দিনের বেলা মাথা ঝিমঝিম করা, মাথা ঘুরানো, নিদ্রালুভাবসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ব্যবহারে আসক্তির জন্ম হতে পারে।