বয়ঃসন্ধিকালে প্রেমের সম্পর্ক

0
629
বয়ঃসন্ধিকাল

বয়ঃসন্ধিকাল জীবনের একটি বিশেষ সময়। এই সময়ে ছেলেমেয়েরা শৈশব কাল পেরিয়ে ধীরে ধীরে যৌবন কালের দিকে যেতে থাকে। শিশুকাল ও যৌবনের মাঝামাঝি সময়কে বলা হয় বয়ঃসন্ধিকাল বা কৈশোরকাল। কৈশোরকাল হলো শৈশব থেকে যৌবনে যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়কাল অর্থাৎ এই সময় হলো এমন একটি সেতু যা শৈশব ও যুবককালের মধ্যে বন্ধন স্বরূপ। এই সেতুর একদিকে শৈশবকাল যার অভিজ্ঞতা কিশোর কিশোরীরা জীবনে অর্জন করেছে। সেতুর অন্যদিকে থাকে যুবকাল, যে অভিজ্ঞতা তাদের হয়নি কিন্তু সেই জীবনে যাওয়ার জন্য মনে থাকে স্বপ্ন, আবেগ আর নিজেকে তৈরির প্রচেষ্টা।

সুতরাং একজন বালক/বালিকা হঠাৎ করেই তরুণ তরুণী হয়ে যায় না। তরুণ/তরুণী হওয়ার জন্য তাদের শরীর ও মনের পরিপক্কতা প্রয়োজন হয় এবং এই পরিবর্তন আসে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ার জন্যই বয়ঃসন্ধিকালকে বালক/বালিকা থেকে তরুণ/তরুণী হওয়ার সেতুবন্ধন বলা যেতে পারে। জীবনের অন্যান্য সময় যেমন শৈশবকাল, যৌবনকাল, বার্ধক্যের মত কৈশোরকালও একটি স্বাভাবিক সময়। তাই কৈশোরকালকে অস্বাভাবিক ভাবার কোনো অবকাশ নেই বরং একে বিশেষ সময় বা কাল বলা যেতে পারে। এই সময় কিশোর/কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তন হয় যার প্রভাব তার আচরণে প্রতিফলিত হয়। এছাড়া এসময়ে তার আবেগীয়, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিয় বিকাশের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়। যার প্রভাব পড়ে তাদের চিন্তায়, কথায় ও কাজে। সব মিলিয়ে এই বয়স ছেলে/মেয়েদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ একটি সময়।

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েরা অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে। তাদের মধ্যে ভালোবাসার আবেগটি প্রবল হয় এবং একই সাথে যৌনতা ও যৌন ভাবনা জেগে উঠে। এ ভাবনা আবেগ ও শারীরিক অনুভূতির বিশেষ চাহিদার জন্ম দেয়। এ চাহিদা থেকেই বিশেষ কারোর প্রতি প্রেমে জড়িয়ে পড়ার প্রবনতা দেখা দেয়। অল্প বয়সের প্রেম কিশোর কিশোরীদের সাময়িকভাবে আনন্দ দেয়, তারা নিজেদের সুখী ভাবে এবং জীবন তাদের কাছে রঙিন হয়ে ওঠে। এই সুখানুভূতি নিয়ে একজন আরেকজনের সাথে আলাপ আলোচনা করে, যার ফলে একজনের দেখাদেখি অন্যরাও প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।

অপরিণত বয়সে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া মোটেই ভালো নয় বরং এতে নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়। এই প্রেমের সম্পর্ক তাদের একটি নতুন পৃথিবীতে নিয়ে যায়, তারা আবেগে আপ্লুত হয়। এই আবেগের ফলে তারা যুক্তির ব্যবহার কম করে, ঠিক কাজটি করছে নাকি ভুল পথে পা দিয়েছে তা বোঝার মতো বুদ্ধি বা যুক্তির ব্যবহার করে না। এর পরিণতিতে শুধু ছেলেমেয়ে নয় বরং উভয়ের পরিবারেও নানা অশান্তি দেখা দেয়। অল্প বয়সে প্রেমের পরিণতি হয় ভয়াবহ। অল্প বয়সের প্রেমের ফলে সাধারণভাবে যেসব সমস্যা দেখা দেয় সেগুলো হলো-

মা-বাবার সাথে সুসম্পর্কের অভাব:
যদি একটি কিশোর/কিশোরী কারো সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং তা মা’বাবা জেনে যান তবে সাধারণত তারা ব্যাপারটি পছন্দ করেন না। মেয়েটিকে/ছেলেটিকে এই সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতে বলেন, ছেলেটি/মেয়েটি থেকে দূরে সরে যেতে বলেন। কিন্তু সচারাচর যা দেখা যায় তা হলো মেয়েটি/ছেলেটি তা মেনে নেয় না, বরং তার ভালোবাসার পক্ষে যুক্তি দেখাতে থাকে। এই টানাপড়েনের ফলে ছেলেটির/মেয়েটির সাথে মা-বাবার সম্পর্কে চিড় ধরে, নষ্ট হয়ে যায় এতদিনের যত্নে গড়ে উঠা সম্পর্ক।

মা-বাবার অনিরাপত্তাবোধ:
নিজের সন্তানটি যখন কারো সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তখন মা-বাবা ভয় পান, মনে করেন সন্তানটি বিপদে পড়তে পারে। খারাপ কিছুতে জড়িয়ে যেতে পারে। এই উৎকণ্ঠা থেকে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারেন।

লেখাপড়ায় অমনোযোগিতা:
কিশোর/কিশোরীরা যখন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তখন প্রেমিক/প্রেমিকাকে নিয়ে এত বেশি আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ে যে সব মনোযোগ থাকে মেয়েটি/ছেলেটির দিকে। এতে সে সাধারণত লেখাপড়ায় মনোযোগ দেয় না, পরিক্ষার প্রস্তুতি ঠিকমতো নেয় না। ফলে পরিক্ষায় খারাপ ফলাফল হয়। লেখাপড়ায় অমনোযোগী হওয়ার কারণে মা-বাবার সাথে সম্পর্ক আরো খারাপ হয়।

শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া:
প্রেমের কারণে ছেলে মেয়েরা আজকাল একজন আরেকজনের সাথে এতটাই কাছাকাছি আসে যে যার পরিণতিতে তারা শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। বিয়ে না করে এই ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া নানা দিক থেকে খারাপ। যেমন ধর্মীয়ভাবে এটিকে মোটেই মেনে নেয়া যায় না আবার শারীরিক ও সামাজিকভাবে এটি নানা কারণে ক্ষতিকর। কিন্তু কিশোর/কিশোরীরা এইসব না ভেবেই যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে।

কিশোরী মেয়ের অন্তঃসত্ত্বা হওয়া:
কোনো ছেলের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার কারণে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়তে পারে। এই পরিণতি তাকে ভয়ংকর দিকে নিয়ে যায়। সন্তানের জন্ম দেয়া যেমন সামাজিক দিক থেকে কঠিন হয়ে পড়ে তেমনি পেটের সন্তানকে নষ্ট করাও একটা বড় ঝামেলার কাজ হয়। এবং শারীরিকভাবেও ঝুঁকির সন্মুখীন হয়। শুধু মেয়েটিই নয় মেয়েটির প্রেমিককেও এই কারণে নানা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হয়।

নিরাপত্তাহীনতা:
যখন একটি মেয়ে/ছেলে কারো সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যায় তখন নানা কারণে একে অপরকে অবিশ্বাস করে। মনে করে মেয়েটি/ছেলেটি অন্য কারো সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। সবসময় ভাবে ছেলেটি/মেয়েটি কার সাথে কথা বলে, কার সাথে মিশে, সামাজিক মিডিয়ায় কার কার সাথে যোগাযোগ করে ইত্যাদি। এইসব ভাবনা ছেলেটি/মেয়েটির মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয়, যা তাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না।

ঝগড়ার ফলে অশান্তি:
আজকাল প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঝগড়া হওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার। নানা ছোটখাটো ঘটনা থেকে ঝগড়া শুরু হয়। দেরিতে দেখা করতে আসা, বিশেষ উপলক্ষে উপহার না দেয়া, অন্য বন্ধুদের প্রতি মনোযোগ দেয়া ইত্যাদি নানা কারণে ঝগড়ার সৃষ্টি হয়। এই ঝগড়ার ফলে তারা নানা অশান্তিতে ভোগে।

ব্ল্যাকমেইল করা:
আজকাল প্রেমের সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে ছেলেরা মেয়েদের ব্ল্যাকমেইল করে থাকে, যার পরিণতি হয় ভয়ংকর। ছেলেরা মেয়েদের আপত্তিকর ছবি তুলে তা সামাজিক মিডিয়াতে ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মেয়েদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে।

অযথা খরচ:
একজন আরেকজনকে খুশি রাখার জন্য নানাভাবে খরচ করে। যেমন- উপহার দেয়া, কোথাও বেড়াতে যাওয়া, রেস্তোরায় খাওয়ানো ইত্যাদি। এই খরচের জন্য তারা অনেক সময় অসামাজিক উপায়ে টাকা জোগাড় করে। যেমন- বাবার পকেট অথবা মা’র ব্যাগ থেকে টাকা সরানো।

প্রেমে ব্যর্থতা ও মাদকাসক্তি:
কিশোর কিশোরীরা অনেক সময় প্রেমে ব্যর্থ হতে পারে। অর্থাৎ ছেলেটি তাকে ছেড়ে অন্য কোনো মেয়ের প্রতি আকর্ষিত হতে পারে। আবার মেয়েটিও অন্য কোনো ছেলের প্রতি আকর্ষিত হতে পারে। এই ব্যর্থতা মেনে নেয়া সবার জন্য সম্ভব নাও হতে পারে। পরিণতিতে অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। জড়িয়ে যায় ভয়ংকর এক মরণ নেশায়।

আত্মীয় স্বজনের প্রতিক্রিয়া:
অল্প বয়সে কোনো মেয়ে/ছেলে যখন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তখন তার আত্মীয় স্বজন ব্যাপারটি মোটেই ভালো নজরে দেখেন না। তারা ধরে নেন ছেলেটি/মেয়েটি খারাপ পথে চলে গেছে। তারা নিজেদের সন্তানদের এমন ছেলেমেয়ের সাথে মিশতে দিতে চান না।

বাল্য বিবাহের সম্ভাবনা:
অল্প বয়সে মেয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়ালে মা-বাবা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সবসময় ভাবেন কখন কি বিপদ হয়। এই বিপদের ভয়ে অনেকেই অল্প বয়সে লেখাপড়া শেষ না হতেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া শারীরিক ও মানসিক দুই দিকের জন্যই ক্ষতিকর।

ভুল মানুষকে সঙ্গী করা:
অল্প বয়সে আবেগপ্রবণ হয়ে সঙ্গী খুঁজতে গিয়ে সাধারণত কিশোর/কিশোরীরা ভুল মানুষকে বেছে নেয়। মেয়েটি/ছেলেটির পরিবার, শিক্ষা, স্বভাব-চরিত্র, মেজাজ, আচরণ ইত্যাদি কিছু না জেনে, না বুঝেই গর্তে ঝাঁপ দেয়ার মতোই প্রেমে পড়ে। ফলে ভুল ব্যক্তির সাথে জড়িয়ে পড়ার পরিণতি ভালো হয় না।

তাই কিশোর/কিশোরীদের বুঝতে হবে কারো প্রতি কৌতুহল/আকর্ষণ বোধ করা মানেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া নয়। অল্প বয়সের প্রেমের কুফলগুলো জানা ও বোঝার মাধ্যমে নিজের বুদ্ধি ও যুক্তির ব্যবহার করে এবং আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে অল্প বয়সের প্রেম থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleআমার সমস্যা হলো কিছু মনে রাখতে পারি না
Next articleভয় পেলে বারবার সেই ভয়ের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here