প্রশ্ন : আমি রাজ। ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট। বয়স ৩৮। গত তিন বছর যাবত সোশ্যাল ফোবিয়াতে ভুগছি। আমি পাচ বছর আগে থেকে প্রচুর গাঁজা খেতাম। কিন্তু সমস্যাটির পর এখন একদমই কমিয়ে দিয়েছি। খাই না বললেই চলে। তিন বছর আগে এক ঘটনায় পুরো পরিবার আমার বিপক্ষে চলে যায়। ফলে আমি সামাজিকভাবে প্রচন্ড নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি ও একাকি মনের মধ্যে বিচরণ করি এবং মানুষের সঙ্গে মিশতে ভয় পাই। এমন কি পরিবারের যে কারো সঙ্গেও আমি সহজ হতে পারি না। বেশিক্ষন একসঙ্গে থাকলে একটা চাপ অনুভব হয়। ফলে আমাশয় হয়। কোনভাবেই আর আমাশয় ভাল হয় না। হাত পা জ্বলে। দিন দু তিবার পায়খানা হয়। এখন খুবই সামান্য পরিমানে গাজা খেলে ভাল থাকি। না মিশতে পারার কারণে চাকরিও ছেড়ে দিয়েছি বছর খানেক ধরে। সারাদিন বাসায় থাকি। ঘুমাই। প্রচন্ড রেগে যাই। শুধু এই না আমার সমস্যা আরো গভীর। যে কোন মানুষ ছেলে বা মেয়ে, মা কিংবা বাবা ছোট কিংবা বড়। সবারই যৌন অঙ্গে আমার চোখ চলে যায়। বুকে, নিচে সব খানে। কেউ খালি গায় থাকলেও সমস্যা হয়। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না। মানুষের সামনে আনইজি ফিল করি। পিজির ডক্টর বলে এটা কিছুই না আপনি এডিক্টেড তাই। এসব বলে আমার বউকেও সন্দিহান করে ফেলেছে। আমি আর সেখানে যাই নি। এখন কোন ওষুধও খাচ্ছিনা।
আমি অনলাইনে দেখেছি বেশ কয়েকটা বিদেশি গ্রুপ আছে। সবাই একটা কমিউনিটির মতো আছে। সেখানেও এই সব হুবহু সমস্যার রোগী রয়েছে। সব সিম্পটম একদম মিল। অনলাইন ডাক্তার সেখানে ‘এসএসআইআর’ খেতে বলেছে। তবে অনেক রোগি বলেছে এই রোগ তারা ১০-১২ বছর ধরে পালছে। এটা নাকি আর ভাল হবে না। আমিও তাই বিশ্বাস করি। যাই হোক , বিস্তারিত কিছু আলোচনা করলে উপকৃত হই। ধন্যবাদ।
উত্তর : ধন্যবাদ আপনার জানার আগ্রহের জন্য। আপনার লেখা থেকে যা জানা গেল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আপনি পাঁচ বছর ধরে গাঁজা সেবন করছেন, আপনার ধারণা, আপনি তিন বছর ধরে সোশ্যাল ফোবিয়াতে আক্রান্ত, আবার একই সময়ের কোন একটা ঘটনায় আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, পরিবারের সদস্য সহ অন্যান্য মানুষদের সাথে মিশতে অসুবিধা হয়, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা হলে আমাশয় হয়, অনেকদিন চিকিৎসার পরও কোন উন্নতি দেখছেন না, আপনার ধারণা গাঁজা খেলে আপনি ভাল থাকেন, বর্তমানে আপনি বেকার, রাগ বেড়ে গেছে, আপনি ঔষধ খাচ্ছেন না। সর্বোপরি, আপনি না চাইলেও অন্য মানুষের যৌনাঙ্গের দিকে চোখ চলে যায়। অর্থাৎ আপনি হয়তো অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারেও ভুগছেন। এটার কোন সময়কাল আপনি উল্লেখ করেন নি। আপনার বিশ্বাস আপনি আর ভাল হবেন না।
প্রথমতঃ আপনার সব সমস্যার উৎপত্তি গাঁজা সেবন থেকেই বলে মনে হচ্ছে। দীর্ঘদিন মাদকাসক্তির অনেক কুফল দেখা যায়, ব্যক্তিগত-পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে। আপনার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। ফলে, পারিবারিক ঝামেলাটা আপনার মনে অতিরিক্ত প্রভাব ফেলেছে। হয়তো আপনার নিরপত্তাহীন মনে হবার বাস্তব কোন পরিস্থিতিও আছে যেটা আপনি ভেঙ্গে বলেন নি। আবার গাঁজা সেবনের ফলে অনেক মানসিক সমস্যার একটি হচ্ছে উদ্বিগ্নতা রোগে আক্রান্ত হওয়া, সেই সাথে অন্যদের প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়া। সবকিছু মিলিয়ে আপনি সোশ্যাল ফোবিয়ার মত সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। তবে, মনে রাখতে হবে আপনার সোশ্যাল ফোবিয়া আছে কিনা তা সরাসরি আপনার সাথে আলাপ না করে নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বা সম্ভব নয়। কিন্তু এই সব সমস্যাগুলো আপনাকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। আর তাই আপনি যে যে সমস্যাগুলো বললেন, কথা বলতে না পারা বা বেকারত্ব, সেগুলো এখন চরম বাস্তবতা। দুঃখের বিষয়, আপনি এখনও ভাবছেন গাঁজা খেলে আপনি ভাল থাকেন বা ভাল বোধ করেন। কিন্তু, সত্যি বলতে, এটা আপনার একটা ভুল সিদ্ধান্ত। এটাকে আমাদের ভাষায় বলা যায় Faulty learning/Faulty technique। কারণ, আপনি একটা ভুল বিকল্প বেছে নিয়েছেন যেটা আসলে কষ্টগুলো সাময়িকভাবে ভুলিয়ে রাখলেও, দিনশেষে আপনার উদ্বেগ বা সমস্যা কমায় না। বরং বাড়িয়ে চলে। তাই, আপনার উচিৎ গাঁজা সেবন ছেড়ে দেয়া এবং ছাড়তে গেলে যা যা করণীয় সেসবই করা। এক্ষেত্রে, আপনার উচিৎ একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া।
এবার আসি আপনার সম্ভাব্য অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারের ব্যাপারে। আপনি যা যা বলছেন তা অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার বা সংক্ষেপে ওসিডি রোগের সাথে মিলে। তবে, সেটাও নিশ্চিত ভাবে আছে কিনা তা একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আপনাকে সরাসরি দেখার পরই শুধু বলতে পারবেন। এই রোগে নিয়মিত ঔষধের পাশাপাশি, সাইকোথেরাপি এবং সামাজিক সহায়তারও দরকার হয় চিকিৎসা হিসেবে। সামাজিক সহায়তার ক্ষেত্রে বাইরের দেশে একই ধরণের রোগীদের বিভিন্ন দলভিত্তিক (Group work) কার্যক্রম থাকলেও আমাদের দেশে তা এখনও চালু নেই। আর, ভালো হবার ব্যাপারে সার্বিকভাবে যেটা বলা হয়, এক বছরের কম ধরে সমস্যা হলে সাধারণত চিকিৎসা করালে ভাল ফলাফল আশা করা যায়। তবে, এক বছরের বেশী সময় ধরে থাকলে সম্পূর্ণ ভাল হবার সম্ভাবনা কমে যায়। সেক্ষেত্রে, উচ্চ-রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, এ্যাজমা সহ এরকম আরো দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক শারীরিক রোগের মতই, অল্প মাত্রায় ঔষধ খেয়ে যেতে হতে পারে আজীবন।
সবশেষে আবারও বলি, এখানে যা বলা হয়েছে তা আপনার কথার উপর ভিত্তি করে কিছু আলোচনা মাত্র। আপনার সমস্যার মাত্রা যেহেতু বেশী, সেহেতু আপনি অতিসত্বর একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন।
ভালো থাকুন। আবারো ধন্যবাদ।