বই জাগতিক অসুন্দর কাজ থেকে দূরে রাখে: দীপংকর দাশ

দীপংকর দাশ- বাতিঘরের সত্ত্বাধিকারী

শুরু করেছিলেন একশো বর্গফুটের একটা ঘর দিয়ে। এখন যেটি একটি শাখা ছাড়িয়ে তিনটি শাখায় গিয়ে পৌঁছেছে।তিনটি বিভাগীয় শহরে বিস্তৃত পরিসরের নান্দনিক বই বা পুস্তক বিপণনকেন্দ্র বাতিঘর।

শুধু বই বা বিপণন কেন্দ্র নয়, বাতিঘর প্রকাশনীও বটে সব মিলিয়ে বৃহত্তর কলেবরের একটি প্রতিষ্ঠান। নগরের যান্ত্রিক জীবনের চাপে হাঁসফাঁস করা মানুষদের জন্য নিশ্বাস নেয়ার একটা স্থান। পাঠকের মনের খোরাকি যোগাতে যে প্রতিষ্ঠানটি বদ্ধপরিকর।

এই সব কিছু যাঁর পরিচর্যায় সম্ভব হয়েছে তিনি দীপংকর দাশ বাতিঘরের সত্ত্বাধিকারী। বই-মন-বাতিঘর নিয়ে তিনি কথা বলেছেন মনের খবরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাদিকা রুমন।

মনের খবর: আপনার কাজটি গতানুগতিক নয় এমন একটি ব্যতিক্রম পথে হাঁটতে মনস্থির করলেন কেন?

দীপংকর দাশ: আমি বই পড়তে পছন্দ করি ছোটোবেলা থেকেই। পরবর্তীতে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র সেসবও বইয়ের সাথেই সম্পৃক্ত রাখে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে আমি চাকরিও করলাম প্রথমে ঢাকায় ছিলাম পরে চট্টগ্রামে।

চট্টগ্রামে যখন আমি গেলাম তখন দেখলাম যে, যেসব বই আমি পড়তে চাই বা আমার বন্ধুরা পড়তে চায় সেসব বই পাওয়া যায় না। প্রথমে স্থানীয় বুকশপগুলোকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করলাম, বললাম এই বইগুলো আমরা চাই। ওরা জানাল, এসব বই বিক্রি হয় না।

কিন্তু আমার মনে হলো উল্টো। মনে হলো, এই বইগুলোর পাঠক সংখ্যা কম না। তখন যেহেতু আমি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে কাজ করি তাই বিভিন্ন প্রকাশক এবং পাঠকদের সাথে একটা যোগাযোগ ছিল। সবমিলিয়ে মনে হলো, কাজটা আমি করতে পারি কিনা। এভাবেই বইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়া।

মনের খবর: বই এবং মন কতটা পরস্পর সম্পৃক্ত?

দীপংকর দাশ: এটা তো পুরোটাই আসলে মনের ব্যাপার। আমরা পৃথিবীর নানা বিষয় সম্পর্কে জানতে চাই। আমরা যেমন জানতে চাই, ছোটোদেরও জানাতে চাই। মানুষের মনের ভাবনারই প্রতিফলন বই। আর এখন তো আমরা জানি যে, মানুষের মন শরীরকে প্রভাবিত করে। কাজেই বই মানুষের মনের খোরাক যোগান দেয় মানে তা শরীরকেও প্রভাবিত করে।

মনের খবর: বই কি মনের বিকাশ প্রক্রিয়ায় প্রভাব রাখে?

দীপংকর দাশ: সেটা তো অবশ্যই। আমি যখন একটা বই পড়ছি তখন আমি অন্য মানুষে পরিণত হচ্ছি। সব বইয়ের সঙ্গেই যে আমি একমত হই এমন না, অনেক বইয়ের চিন্তার সঙ্গে দ্বিমতও পোষণ করি। কখনো কখনো লেখকের সঙ্গে তর্ক করতে পারি। ফলে আমরা একটা বই পড়ার সময় জাগতিক অসুন্দর ব্যাপারগুলো থেকে দূরে থাকি, মানসিক বিপর্যয়গুলো থেকে দূরে থাকি।

মনের খবর: লকডাউনের কারণে দীর্ঘ সময় সবাইকে ঘরবন্দি থাকতে হয়েছে সময় বই মানুষকে কতটা সহযোগিতা করেছে?

দীপংকর দাশ: আমার মনে হয়, এই সময়টাতে সারা পৃথিবীতেই বই পড়া বেড়ে গিয়েছিল। আমি নিজেকে দিয়েই দেখলাম, বেশ কিছু বই যেগুলো পড়া হয়নি, পরে পড়ব বলে ভেবেছিলাম সেগুলো শেষ করেছি। আমার মতো অন্য অনেকেই হয়ত এরকম আছেন।

আমরা একটা সময় বন্ধ করে দিয়েছিলাম বাতিঘর। পনের বা বিশ দিন পরই আমরা আবার সীমিত আকারে খুলে দিই ঘণ্টা দুয়েকের জন্য। পাঠকের দিক থেকে আমাদের ওপর একটা চাপ ছিল যে তারা পড়তে চান। তখন আমরা কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে দুই ঘণ্টার জন্য খুলে বই কুরিয়ার করতাম।

যখন একটা কুরিয়ার চালু হয় আরকি। তার আগে তো উপায় ছিল না। সেখান থেকেই আমরা বুঝতে পারতাম যে, অনেকে পড়তে চাচ্ছেন। সেসময় আসলে বই পড়া বেড়েছিল। বিক্রি বেড়েছিল এরকমটা বলতে পারছি না। কারণ আমাদের ডিস্টট্রিবিউশন ব্যবস্থা অপ্রতুল। বাইরে যেমন নানারকম ব্যবস্থা আছে আমাদের এখানে সেটা দুর্বল। বিপণন ব্যবস্থায় বেশকিছু ঘাটতি রয়েছে। নইলে আমাদের এখানেও হয়ত ভালো ব্যবস্থাপনা থাকলে বইয়ের বিক্রি ঐ সময়টাতে বেড়ে যেত।

মনের খবর: বই কারো জীবন বদলের কারণ হয়ে উঠেছে, এরকম কোনো অভিজ্ঞতা কি আপনার হয়েছে?

দীপংকর দাশ: সুনির্দিষ্ট ঘটনা এখন মনে আসছে না। তবে এরকম প্রতিনিয়তই হয়। হয়ত মানসিক বিপর্যয়ের সময় কেউ বই পড়তে শুরু করলে তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে।

মনের খবর: বাতিঘর আপনাকে কী দিয়েছে?

দীপংকর দাশ: প্রথমত আমি যা করতে চেয়েছিলাম তা-ই করতে পেরেছি। বইয়ের সঙ্গে, বইয়ের মানুষদের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম আমি। যারা বই পড়েন, লেখেন তাদের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম। আমাকে অন্যকিছু আর করতে হয়নি এটাই প্রাপ্তি, আমার ভালো লাগার জায়গা।

মনের খবর: একটা লাইব্রেরি বা বইকেন্দ্রিক কোনো সংগঠন, প্রতিষ্ঠান বা বিপণন কেন্দ্র কি সমাজকে প্রভাবিত করতে সক্ষম? মন এবং মননকে পরিবর্তন করতে সক্ষম?

দীপংকর দাশ: আমাদের চট্টগ্রাম বাতিঘরের পাশে স্কুল আছে একটা। একবার একজন অভিভাবক এসে বললেন, তার বাচ্চা প্রথমবার সেখানে চান্স পায়নি দ্বিতীয় বারে ভর্তি হয়েছে। তার কারণ হলো পাশে বাতিঘর আছে সে প্রতিদিন এখানে আসতে পারবে। এটা খুব আনন্দের ব্যাপার ছিল আমার জন্য।

বাচ্চাটি হয়ত আরো ছোটোবেলা থেকে বাতিঘরের পাশের স্কুলে পড়ার স্বপ্ন দেখেছে। এভাবে ভাবতে গেলে বইকেন্দ্রিক একটি প্রতিষ্ঠান সম্ভবত পারে সমাজের ভেতর একটা পরিবর্তনের ধারা তৈরি করতে।

মনের খবর: বাতিঘর কি পাঠকমন তৈরি করেছে?

দীপংকর দাশ: আসলে মানুষ বা মানুষের মন তৈরিতে তো অনেকগুলো প্রভাবক কাজ করে তার পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি। পাশাপাশি বইয়ের যোগানের ব্যবস্থা। আমরা যেটা চেয়েছিলাম সেটা হলো বইকে সহজলভ্য করা। অনেক সময় দেখা যায় আমরা টাকা খরচ করেও বই পাচ্ছি না।

আমার লক্ষ্য ছিল প্রথমত, বইয়ের একটা ভালো স্টক রাখা। তারপর হচ্ছে যে, যদি বই না-ও থাকে দ্রুত সেটা যাতে আমরা এনে দিতে পারি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, যখন আমরা একটা বই পড়ি তখন আরো দশটা বইয়ের রেফারেন্স পাই। যখন আমি সেই বইগুলো পড়তে পারলাম না তখন আমি বঞ্চিত বোধ করি। আমার মনে হয় অনেক সময় এতে পাঠকের মৃত্যু ঘটতে পারে। এই শূন্যতার জায়গাটি আমরা পূরণ করার চেষ্টা করছি কীভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়, তার ভেতরে পাঠের যে তৃষ্ণা সেটাকে কীভাবে আরো বাড়ানো যায়।

মনের খবরের পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে

দীপংকর দাশ: আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ মনের খবরকে।

Previous articleকরোনা মোকাবেলায় আতঙ্ক নয় বরং সতর্কতাই মূল কথা
Next articleরাজশাহীতে করোনায় আক্রান্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here