প্রশংসা সন্তানের নিজস্ব মূল্যবোধ গড়তে সহায়তা করে

শামীমা সিরাজি সুমি

প্রশংসা আপনার সন্তানের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মিকবোধকে লালন করে। এটি বাচ্চাদের চৌকস বিকাশে সহায়তা করে। কারণ প্রশংসা মস্তিষ্কের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করে। বাচ্চাদের মস্তিষ্ক স্বাস্থ্যকরভাবে বৃদ্ধির প্রয়োজন। তাই এই ধরনের ইতিবাচক উদ্দীপনা প্রদান করে তাদের বুদ্ধি বিকাশে প্রশংসা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

প্রশংসার সাথে সুখি হরমোনের সম্পর্কঃ

আমরা সবাই জানি যে, হরমোন হলো আমাদের শরীরে থাকা এক রাসায়নিক দূত। এই হরমোন তৈরি হয় মস্তিষ্কের পিটুইটারি নামক গ্রন্থিতে। হরমোনটি তৈরি হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে যায়। সেই অঙ্গগুলোতে এই হরমোনকে গ্রহণ করার জন্য থাকে বিশেষায়িত ব্যবস্থা।

১৯২৬ সালে স্যার চার্লস হ্যারিংটন তার গবেষণাগারে হরমোন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ধীরে ধীরে হরমোন নিয়ে গবেষণা যত সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলো, ততই উদঘাটিত হওয়া শুরু করলো বিস্ময়কর সব তথ্য।

আমাদের মনোজাগতিক নানা পরিবর্তনের সাথে হরমোন জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। আমাদের ভালো লাগা, ভালোবাসা জন্যও কিছু হরমোন কাজ করে। যেমনঃ ডোপামিন, সেরাটোনিন আর অক্সিটোসিন হরমোন এর মধ্যে অন্যতম। আর এ জন্যই এদেরকে Happy hormone নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

কোনো কাজের প্রত্যাশা মাফিক ফল পাওয়ার পরে আমাদের যে চরম আনন্দের অনুভূতি হয় তার জন্য দায়ী ডোপামিন। কোনো কাজে সফলতা অর্জনের পরে এই ডোপামিন নিঃসরণ অনেকটা মানসিক পুরষ্কারের মতোই কাজ করে।

এবার আসা যাক অক্সিটোসিনের কথায়। অক্সিটোসিন মানুষের বন্ধুত্ব এবং আবেগের সাথে জড়িত। বন্ধু কিংবা ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে প্রশংসাসূচক কথা শুনলে ঐ সময়ে দেহে অক্সিটোসিনের মাত্রা অনেক বেশি থাকে। দীর্ঘদিন পরে কোনো প্রিয় জনের প্রিয় কথাগুলা মনে হলেও বা তার সাথে দেখা হলেও এই হরমোন নিঃসরিত হয়। এতে বোঝা যায়, আমাদের মানসিক এবং আবেগঘটিত সম্পর্কগুলোতে অক্সিটোসিন হরমোনের গুরুত্ব অনেক বেশি।

উচ্চমাত্রার সেরোটোনিন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা আর আবেগের সঞ্চার ঘটায়। পাশাপাশি আমাদের মনোজাগতিক অবস্থার ভালো-মন্দ নির্ধারণে সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন আর ডোপামিনের গুরুত্ব অনেক। এদেরকে নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়।

ভালোবেসে যেসব শিশুদের যত বেশি প্রশংসা করা হয় আগামীতে তারা ততবেশি আত্মবিশ্বাসী-

অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, বাচ্চাদের প্রশংসা করলে তারা অন্যদের থেকে নিজেদেরকে আলাদা ভাবে এবং নিজেকে অনেক শক্তিশালী মনে করে। তাই, শুধু নিজের বাচ্চার প্রশংসা করলে চলবে না আপনার বাচ্চার সামনে অন্যদের প্রশংসাও করতে হবে।

তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, সেই প্রশংসা যেন অযথা না করা হয় বা যে কাজটা সে করেনি বা যে বৈশিষ্ট্যটি তার মাঝে নেই এই ধরণের প্রশংসা করবেন না। আপনার কোন কাজ হাসিল হবে ভেবে সেটাও করা একেবারে অনুচিত। লক্ষ্য করবেন, শিশুরা জন্ম নেয় নিষ্পাপ হয়ে কিন্তু বড়দের নেতিবাচক আচরনের প্রভাবের ফলে শিশুরা নেতিবাচক আচরন করতে শেখে ।

তাই শিশুদের মুক্তভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দিতে হবে মা-বাবা, অন্যান্য অভিভাবক এবং স্কুল শ্রেনীকক্ষে শিক্ষকদের। শ্রেনীকক্ষে সাধারণত দেখা যায় যে, কিছু বাচ্চারা শান্ত, ভীষণ লাজুক ধরণের রেসপন্স করে না কিন্তু মেধাবি বা পারফরমেন্স অনেকের তুলনায় ভাল।

কিন্তু দেখা যায় যে, যারা রেসপন্স করে বেশি, পারফরমেন্স ভালো বা মোটামুটি শিক্ষকরা তাদের প্রশংসা করে থাকেন বেশি। তখনই introvert ছাত্রটি কিন্তু একটা সময়ের পরে আর ভালো ফলাফল করে না। কারণ তার প্রতি শিক্ষকদের মনোযোগ ছিল না বা সে কখনই শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রশংসা পায়নি এবং সে হীনমন্যতায় ভোগে।

বাচ্চাদের প্রশংসা করা গুরুত্তপূর্ণ কেন?

“Praise is like fuel that powers the self-esteem of children”. প্রশংসা সন্তানদের মূল্যবান ও আত্ম-সম্মানের একটি নিজস্ব বোধ তৈরি করে। বাচ্চারা বুঝতে পারে তাদের মূল্য আছে এবং তাদের ইতিবাচক আচরণের ফলে তারা সবার কাছ থেকে মনোযোগ পায়, সবাই তাদের ভালোবাসে।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রশংসা গ্রহণের মাধ্যমে বাচ্চারা সাবলম্বি হয়, সঠিকভাবে নিজেকে এবং অন্যকেও মূল্যায়ন করতে শিখে। পড়াশুনায় ভালো গ্রেড পায়, যার ফলে ভবিষ্যৎ জীবনে অনেক উন্নতি করে বা উৎপাদনশীল কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখে।

আমরা সাধারণত দুইভাবে প্রশংসা করে থাকি। বর্ণনামূলক প্রশংসা ও সংক্ষিপ্ত প্রশংসা।

সংক্ষিপ্ত প্রশংসা: তোমাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে, তুমি খুব ভাল একটি কাজ করেছ, তোমাকে ধন্যবাদ, তুমি একজন ভালো ছেলে/মেয়ে ইত্যাদি।

বর্ণনামূলক প্রশংসা: আপনার পছন্দের কাজটি আপনার সন্তান করেছে। উদাহরণস্বরূপ- ওর পড়ার টেবিলটি সে সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখে বা বড়দের দেখে সালাম দিয়েছে বা ও সুন্দর করে গুছিয়ে একটি ছড়া বলেছে।

যে ধরনটা আপনার মনের মতন হয়েছে তখন আপনি ওকে আদর করে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার এই কাজটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। এটি আপনার শিশুকে সঠিকভাবে বুঝতে সাহায্য করে যে, সে ভালো করেছে।

সে একজন ভালো ছেলে। এটি অনির্দিষ্ট প্রশংসার চেয়েও বেশি উপযোগী। উদাহরণস্বরূপ- তুমি গণিতের হোমওয়ার্কে কঠোর পরিশ্রম করেছ। এটি আমাকে ভীষণ শান্তি দিয়েছে বা ভালো একটি কাজ করেছ। এরকম ভাবে প্রশংসার প্রচেষ্টা আপনার শিশুকে অনুপ্রাণিত করতে এবং ভবিষ্যতে কঠোর চেষ্টা করতে আগ্রহী করতে পারে।

প্রশংসা বাচ্চাদেরকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করে। যদি তারা তাদের মা-বাবা, যতœশীলদের এবং শ্রেনী শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রশংসা এবং উৎসাহ পান। এ বিষয়টি খুব বেশি কার্যকরী যে, প্রশংসা করার সময় বাচ্চাদের চোখের দিকে তাকিয়ে (Eye contact) প্রশংসা করতে হবে। দুটি উপায় রয়েছে যাতে আপনি কার্যকরভাবে আপনার বাচ্চাদের প্রশংসা করতে পারেন। “Praise for Being” and “Praise for Doing।

Praise for Being: আমরা যখন আমাদের বাচ্চাদের বলি, তুমি আমার সোনা যাদু মনি/লক্ষি একটা মেয়ে/ছেলে, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি, তোমাকে সন্তান হিসেবে পেয়ে আমি গর্ববোধ করি। তার মানে হচ্ছে শর্তহীন প্রশংসা বা unconditional  praising।

এ ধরনের প্রশংসা Self worthy করে গড়ে তুলবে বা নিজেকে যথাযথভাবে মুল্যায়ন করতে শিখবে। মা-বাবার এবং পরিবারের কাছে সে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সেটা সে ভাবতে শিখবে, সবসময়ে জন্য মা-বাবা যে তার কাছের মানুষ এই জরুরী বিষয়টা সে লালন করবে মনেপ্রানে।

Praise for Doing: যে কোন ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করা। যেমন- তুমি কি সুন্দরভাবে তোমার পড়ার টেবিল টা বা খেলনা গুলো গুছিয়ে রেখেছ কিংবা আমি খুব খুশি হয়েছি শুনে যে তোমার ছোট ভাইকে তুমি অনেক যত্ন করে দেখে রেখেছ বা তুমি অংকে ভালো স্কোর পেয়েছ। তাই আমার গর্ব হচ্ছে তুমি খুব দায়িত্বশীল হয়েছ। মা-বাবা যদি একসাথে মিলে এ ধরনের প্রশংসা বাচ্চাদেরকে করে তাহলে বাচ্চারা অনেক বেশি অনুপ্রানিত হয়। বাচ্চারা ছোট মানুষ হলেও মানব মন স্বীকৃতি চায়।

তবে অবশ্যই এই প্রশংসার ধরণগুলো বয়স উপযোগী হতে হবে এবং যেন পক্ষপাত দুষ্টু না হয়। মনে রাখবেন, বাচ্চা যদি তার বয়সের তুলনায় বেশি প্রশংসা পেতে থাকে তাহলে সেটা বা যা সে সঠিকভাবে করেনি তার জন্য প্রশংসা পেতে থাকে তাহলে সে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পরবে। তার একাডেমিক এবং অন্যান্য পারফমেন্স কমে আসতে থাকবে। এবং সে একসময় হতশায় ভুগতে পারে।

প্রশংসা ইতিবাচক একটা প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানব মনের বিকাশ সঠিকভাবে গঠিত হয়। এভাবেই মা-বাবারা প্রশংসার মাধ্যমে আপনাদের সন্তানদের নিজস্ব মূল্যবোধ ও ইতিবাচক ধারণা বাচ্চাদের মাঝে তৈরি করতে সহায়তা করুন। যা আপানার সন্তানকে উজ্জীবিত করবে ভালো ও সফল মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে। তাই সবশেষে বলতে চাই, ছোটবেলা থেকেই প্রশংসার প্রবেশ ঘটুক সকল শিশুর আচরনে, আত্মবিশ্বাস ও অনুপ্রেরনা জাগ্রত হোক তার আবেগীয় মনে।

 

শামীমা সিরাজি সুমি
চাইল্ড সাইকোলজিস্ট, আইসিডিডিআরবি

এক্সপার্ট ইন আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট এন্ড সাইকো-সোশাল স্টিমুলেশন

Previous articleদাম্পত্য সম্পর্কিত ভুল ধারণা
Next articleহস্তমৈথুনে শারীরিক উপকারিতা ও অপকারিতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here