কালের পরিক্রমায় বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধ হতে থাকে শরীর-মন দুটোই। বয়সের সাথে সাথে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন- কার্যক্ষমতা কমে যায়, ঠিক তেমনি মনের উপর এর প্রভাবও পরিলক্ষিত।
শারীরিক অসুস্থতা বা দুর্বলতা, সামাজিক জীবনের পরিবর্তন, নির্ভরশীল হয়ে পড়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই জীবন যাত্রার মান কমে যায়। দীর্ঘমেয়াদী অসুখ এবং শক্তিহীন হয়ে পড়া অনেকের মনে দুশ্চিন্তা এবং আশাহীনতার জন্ম দেয়, নিজেকে আর মূল্যবান মনে হয় না এই সমাজ সংসারে–ফলশ্রুতিতে আগমন ঘটতে পারে বিষন্নতার! বিষন্নতা এমন একটি মানসিক রোগ যা কিনা কর্মক্ষমকে করে দিতে পারে অক্ষম।
এমনকি তীব্র বিষন্নতায় বেড়ে যায় আত্নহত্যার ঝুঁকি। বর্তমান যুগে ৬০ বছরের বেশি মানুষের মধ্যে বিষন্নতা এবং আত্নহত্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। কারণ গত শতাব্দী থেকেই আত্নহত্যার হার বেড়ে গিয়েছে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে।
প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্নহত্যার হার কেন বেড়ে গিয়েছে এই প্রশ্নের উত্তর খোজার জন্য সম্প্রতি এক লিটারেচার রিভিউ (অনেকগুলো সংশ্লিষ্ট গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করা) প্রকাশিত হয়েছে। ২০০০-২০২১ সাল পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত “প্রবীণদের মধ্যে বিষন্নতা ও আত্নহত্যার হার” বিষয়ক গবেষণা প্রবন্ধগুলো প্রথমে যাচাই বাছাই করে ২৪টি গবেষণা নির্দিষ্ট করা হয় পুর্নবিশ্লেষণ করার জন্য।
এখানে সর্বমোট প্রবীণ জনগোষ্ঠী ছিল ৩০৬,১৭৩ জন। বেশিরভাগ গবেষণা প্রবন্ধের প্রকাশকাল ছিল গত ৫ বছরের মধ্যে। এশিয়া থেকেই বেশিরভাগ প্রবন্ধ পাওয়া যায়, এরপর ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা। কিছু ছিল অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকার গবেষণা।
ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৬০ বা তার বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে বিষন্নতার হার ৫.৩৭% থেকে ৫৬% পর্যন্ত। বিষন্নতায় ভোগা প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীদের আধিক্য বেশি কিন্তু আত্নহত্যার হার বেশি প্রবীণ পুরুষদের মাঝে। ৭০% গবেষণা চিহ্নিত করেছে যে, আত্নহত্যার কারণ মানসিক সমস্যা বিশেষ করে বিষন্নতা প্রধান কারণ।
এছাড়াও উদ্বিগ্নতা, স্কিজোফ্রেনিয়া, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিশক্তি লোপ, মানসিক চাপ ইত্যাদিও দায়ী আত্নহত্যার কারণ হিসেবে। মানসিক রোগ বা কারণ ব্যতীত অন্যান্য বিষয় যেমন, দীর্ঘ মেয়াদি শারীরিক অসুস্থতা, ক্যান্সার, আর্থ-সামাজিক অবস্থান, যৌন সমস্যা, একাকী বসবাস ইত্যাদি বিষয়ও ছিল যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিষন্নতার কারণ বা এর তীব্রতা বাড়ায় এবং আত্নহত্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
আধুনিকতার এই যুগে ইন্টারনেট এবং অন্যান্য টেকনিকাল উন্নয়ন এর সময়ে অনেক দেশ থেকেই যুবসমাজের একটি বড় অংশ প্রবাসী হয় প্রবীণদের একা ফেলে যা কিনা তাদের দেখভাল করার বিষয়ে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা।
যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাওয়াও একটি কারণ। বার্ধক্যে বিষন্নতার প্রথম লক্ষ্মণ হল স্বাভাবিক কাজকর্মে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা, যা অনেক সময়ে লক্ষ্য করা হয় না বা তারা নিজেরাও ব্যাখা দিতে পারেন না, অনেক সময় শারীরিক সসমস্যার কথা বলেন (সোমাটাইজেশন), তাই বিষন্নতা নির্ণয় এবং চিকিৎসাও করা হয় না প্রায়শই। ১৩০০ জন প্রবীণদের মাঝে করা এক গবেষণা বলেছে ২৭% ভুগছেন বিষন্নতায়। চায়না, কানাডা এবং আমেরিকায় প্রবীণদের বিষন্নতা এবং আত্নহত্যার হার অনেক বেশি। বিশ্বব্যাপী প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্নহত্যা করে।
২০০০ সালে ৬৫ বছরের অধিক বয়সীদের মাঝে আত্নহত্যার হার ছিল ১৮%। ২০১০ সালে ৬০-৬৪ বয়সীদের মাঝে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ১৭তম অবস্থানে ছিল আত্নহত্যা। মালয়েশিয়াতে তুলনামূলকভাবে এই হার কম, প্রতি লাখে ৩ জন, যার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস। কিছু গবেষণায় আত্নহত্যার কারণ হিসেবে সরাসরি চিহ্নিত করা হয়েছে বিষন্নতাকে।
৬৫-৭৪ বয়সীদের মাঝে অর্ধেক গবেষণার ফলাফল ছিল বিষন্নতা। অন্যান্য গবেষণার ফলাফল ছিল মানসিক সমস্যা, শারীরিক রোগ (ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, হার্টের সমস্যা, পারকিনসন্স ডিজিজ, বাতব্যথা), দারিদ্র্য, প্রিয়জনকে হারানো, একা বসবাস, মাদকাসক্তি এবং হাসপাতালে অবস্থান।
আত্নহত্যার ঝুঁকি বেশি বৃদ্ধ নারী বিশেষ করে বিধবাদের ১.৫ থেকে ৩ গুন বেশি বিষন্নতা পুরুষদের তুলনায়। কিন্তু আত্নহত্যার হার পুরুষের মাঝে ২ থেকে ৩ গুণ বেশি নারীদের তুলনায়। এর কারণ হতে পারে, পুরুষ রা কম সাহায্য নেয় নিজের সমস্যার ব্যাপারে এবং বিপদজনক পন্থা অবলম্বন করে আত্নহত্যার ক্ষেত্রে।
প্রবীণদের মাঝে বিষন্নতা ও আত্নহত্যার ঝুঁকি কমাতে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত চিকিৎসা ব্যাবস্থা গ্রহণ করাই প্রতিরোধ এর উপায়। মানসিক রোগ ও শারীরিক রোগের যথাযথ চিকিৎসা এবং সামাজিক ও পারিবারিক ভাবে তাদেরকে সহায়তা করা হতে পারে আত্নহত্যা প্রতিরোধ এর অন্যতম প্রধান উপায়।
লিখেছেন- সাদিয়া আফরিন
রেসিডেন্ট এমডি (চাইল্ড এন্ড অ্যাডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
Reference : Prevalence of Major Depressive Disorder and Correlates of Thoughts of Death, Suicidal Behaviour, and Death by Suicide in the Geriatric Population—A General Review of Literature
Gloria Obuobi-Donkor, Nnamdi Nkire, and Vincent I. O. Agyapong
Behav Sci (Basel). 2021 Nov; 11(11): 142.
Published online 2021 Oct 21. doi: 10.3390/bs11110142
PMCID: PMC8614881
PMID: 34821603
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে