ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয় ও চিকিৎসা

ডেঙ্গি জ্বর নির্ণয় ও চিকিৎসা

বাংলাদেশে সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তবে এবার বর্ষার আগেই ডেঙ্গু বা মশাবাহিত রোগগুলো ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রতিদিন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন হাজার হাজার রোগী। অনেকে মারাও যাচ্ছেন। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করা গেলে ও জ্বরের মাত্রা বুঝে চিকিৎসা দিলে ডেঙ্গু থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া এডিস মশাবাহিত ভাইরাল ইনফেকশন। ডেঙ্গু হলে বিছানায় শুয়ে পাশ ফিরতে, টয়লেট করতে চরম ব্যথা। ব্যথা তিন সপ্তাহের মধ্যেই সারে, অনেকের তিন মাসের বেশি লাগে। সব ব্যথা সম্পূর্ণ সেরে যায়। ডেঙ্গুতে মাজায় ব্যথা হতে পারে, মাসল পেইন, বোন পেইন হলেও গিরায় এত সিরিয়াস ব্যথা হয় না, বেশি দিন থাকে না।

সাধারণত তিনটা পর্যায়ে ডেঙ্গু হয়- ফেব্রাইল, এফেব্রাইল (ক্রিটাক্যাল), কনভালেসেন্ট ফেজ।

ফেব্রাইল ফেজ: ভাইরাস জ্বরের যত উপসর্গ (জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, শরীর ব্যথা, পেট ব্যথা, বমি) সব হয়। ডেঙ্গু জ্বরের বিশেষত্ব হলো গিরার চেয়ে হাড়ের ব্যথা বেশি (ব্রেক বোন ডিজিজ), চোখের পেছনে ব্যথা (চোখ ঘুরালে ভীষণ লাগে)।

এফেব্রাইল ফেজকে ক্রিটিক্যাল বলার কারণ হলো এ সময় রক্তক্ষরণ, শক এবং মৃত্যু হতে পারে।

ডেঙ্গুকে তিনভাবে বর্ণনা করা হয়। ডেঙ্গু ফিভার, ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার (ডিএইচএফ) ও ডেঙ্গু শক সিন্ড্রম। এখন ডিএইচএফ আগের তুলনায় বেশি, কারণ দ্বিতীয়বার হলে ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার (ডিএইচএফ) হয়। একবার ডেঙ্গু হলে এক বছরের মধ্যে ডেঙ্গু হয় না। পরবর্তী সময় হওয়ার আশঙ্কা ০.৫ শতাংশ।

রক্তক্ষরণ থাকলেই সেটা হিমোরেজিক নয়। জ্বরের সঙ্গে প্লাটিলেট সংখ্যা এক লাখের কম হতে হবে আর হিমাটক্রিট ২০ শতাংশ বাড়তে হবে অথবা বেশি থাকলে চিকিৎসায় ২০ শতাংশ কমতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বরের সময় অনেকের পুনর্বার মাসিক (রক্তক্ষরণ) হয়, এটা প্লাটিলেট স্বাভাবিক থাকলেও হয়, এটা হিমোরেজিক ডেঙ্গু নয়। ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার গ্রেড-২ ও গ্রেড-৩ কে একত্রে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রম বলে। এ ধরনের ভেদটা মূলত রক্তচাপ ও পালসের ওপর নির্ভর করে। যেমন- প্রেসার পালস রেকর্ড না করা গেলে সেটা শক।

এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিন্ড্রম: ২০১৩ সাল থেকে এটিপিক্যাল উপসর্গগুলোকে আমলে নিয়ে আরেকটি ক্যাটাগরি করা হয়েছে যেটার নাম এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিন্ড্রম। এটিপিক্যাল উপসর্গের সঙ্গে এখানে এসজিওটি পিটি অনেক বাড়ে (এক হাজারের বেশি)। সব ডেঙ্গুতেই ওটি পিটি বাড়ে তবে এত নয়। ওটি পিটির চেয়ে বেশি বাড়ে, কারণ মায়োসাইটিস বা মাংসের প্রদাহ হয়। প্লাটিলেটও অনেক কমে।

ওয়ার্নিং সিম্পটম (সতর্কতামূলক উপসর্গ): চিকিৎসা করতে গিয়ে এটা উপলব্ধি করতে হবে। বিশেষ করে বাচ্চাদের বেলায়। পেটের ব্যথা কমছেই না, বমি কোনো মতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না, রক্তক্ষরণ হচ্ছে বা রোগী ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে, পাল্স ব্লাড প্রেশার দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে।

হাত দিলে পেট শক্ত মনে হয় (পেরিটনাইটিস)। এগুলো হিমোরেজিক ডেঙ্গু খারাপ হওয়ার লক্ষণ; হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করার বার্তা। সময়োপযোগী উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে ভালো হয়ে যাবে।

চিকিৎসা: প্যারাসিটামল-ডেঙ্গু ফিভার অন্য ভাইরাসের মতোই। প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কিছু লাগবে না।

পানি (ফ্লুইড): পানি এবং পর্যাপ্ত পানিই ডেঙ্গুর মূল চিকিৎসা। প্রথম থেকেই তিন লিটার নিশ্চিত করতে পারলে সাধারণত অসুবিধা হয় না। হিমোরেজিক ফিভারে আসলে রক্তনালি লিক করে তাই রক্তকণিকা, প্রোটিন পানি, লবণ সব এলোমেলো হয়ে যায়; ক্রিটিক্যাল ফেজের দিনগুলোতে (২-৩ দিন) এগুলো হয়। লিকের জন্য শক হয়, শক প্রতিরোধের জন্য পানি দিতে হয়।

রক্ত ভরা: রক্তক্ষরণ হতে থাকলে, ব্লাড প্রেশার কমলে হিমাটক্রিট কমলে রক্ত দিতে হয়।

ক্যারিশমা হলো ব্যালান্স ঠিক রাখা, কারণ বেশি দিলে পানি ফুসফুসে (প্লুরাল ইনফিউশন), পেটে (এসাইটিস), ব্রেইন (ইডিমা) জমবে। সে জন্য গ্রেড-২ বা ওয়ার্নিং উপসর্গ থাকলে, গ্রেড থ্রি, ফোর হলে শকে গেলে, মাল্টি অর্গান ফেইলিওর হলে হাসপাতালের বিশেষ করে আইসিইউতে চিকিৎসা দিতে হবে ও ডেঙ্গু গাইডলাইন অনুসারে ফ্লুইড দিতে হবে। আসলে ডেঙ্গু চিকিৎসায় ফ্লুইড (পানি) ম্যানেজমেন্টই আসল।

অন্য ওষুধ: ডেঙ্গু চিকিৎসায় করটিকোস্টেরয়েড, প্লাটিলেট, প্লাটিলট রিচ প্লাসমা কোনোটারই কার্যকারিতা নেই।

কনভালেসন্ট পিরিয়ড: কনভালেসন্ট পিরিয়ডে জ্বর অনেক দিন (প্রোলংগড) থাকতে পারে, কোনো সংযুক্ত ইনফেকশন হলো কিনা সেটা খুঁজতে হবে। অনেকে ডিপ্রেশনে বা অযৌক্তিক দুর্বলতার (ক্রনিক ফ্যাটিগ সিন্ড্রমে ভুগতে পারেন।

প্রতিরোধ: ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রতিরোধ একই। মশা ঠেকাতে হবে। পাত্রের (জলকান্দা, নির্মীয়মাণ বাড়ির চৌবাচ্চা, ফেলে দেওয়া টায়ার, নারিকেলের খোসা, পেপসি-কোলার ক্যান ইত্যাদি) পানি ৫ দিনের বেশি জমবে না, মশার লার্ভা হয়ে পাত্রে মশার বংশ বিস্তার হবে।

ঘরের মশা মারার জন্য সম্ভব সব ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে, গৃহপালিত এডিস মশাকে মারতে হলে পাত্রে, টেবিলের নিচে, পর্দার ভাঁজে, ওয়েটিং রুমে স্প্রে করতে হবে।

চিকিৎসা: বৃষ্টির এ মৌসুমে জ্বর ডেঙ্গু হয়, এখন তাই ব্যাপক হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি হয় সেপ্টম্বর-অক্টোবরে। এ সময় যে কোনো জ্বর হলেই ডেঙ্গু ভেবে চিকিৎসা শুরু করা ভালো। তিন-চার দিন টানা জ্বর থাকলে সম্ভব হলে টিসিডিসি, এসজিপিটি, ডেঙ্গু এনএস-১ অ্যান্টিজেন টেস্ট করা যেতে পারে (কোনোটাই অত্যাবশ্যকীয় নয়)।

আক্রান্তদের প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ কার্যকরী নয়। পরিমিত পানিই সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা। অনিবন্ধিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু চিকিৎসা করা যাবে না।

শিশু, গর্ভবতী মা, প্রবীণ, ডায়াবেটিস বা অন্য এক বা একাধিক ঝুঁকি (কো-মরবিডিটি) যাদের আছে তাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleঘর বন্দী থেকেও শরীর ফিট রাখার উপায়
Next articleমহামারীতে মানসিক শক্তি বাড়াবে পরিবার ও বন্ধুদের সাথে পুনর্মিলন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here