জীবনের রসায়ন

বিজ্ঞান বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশুনার ফলে রসায়ন শব্দটার সাথে বেশ আগেই পরিচিতি হয়েছিল। সাধারণভাবে আমরা সবাই হয়তো এটা বুঝি যে, একটা আর একটার সাথে ক্রিয়া বা বিক্রিয়া নিয়ে যে বিষয়ে আলোচনা হয় সেটাই রসায়ন। রসায়ন শব্দটা একেবারে আমার অন্তরে ঢুকেছে মনোরোগবিদ্যা পড়তে এসে।
মনোরোগবিদ্যা পড়াশুনা ও রোগী দেখতে গিয়ে বুঝতে পারলাম আমাদের আচার আচরণও রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়া দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমরা প্রায়ই খুব অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন বা পরিস্থিতির সম্মুখীন হই যা বরাবরই আমার মনে দাগ দিয়ে যায় আর মনে করিয়ে দেয় সেই অদ্ভুত জীবন রসায়ন। আমরা এমন রোগীদেরকে সেবা দিতে পারি যারা মনে করেন না তাদের নিজের কোনো রোগ আছে, অন্যরা সবাই তার ক্ষতি করার চেষ্টা করতেছে, পরিবারের লোকজন তাদের জোর করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। কিছু দিন ওষুধ খাওয়ার পর রোগীরা বুঝতে পারেন তাদের আসলে রোগ ছিল, কেউ আর তাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করতেছে না, এখন আর কানে আলগা কথা আসে না ইত্যাদি। আবার কিছুদিন পর ওষুধ খাওয়া বাদ দিলে এই রোগই আবার সেই পুরান অবস্থায় ফিরে আসে। আমার বেশ কৌতূহল হত এগুলো কীভাবে সম্ভব?
আর এক ধরনের রোগের কথা বলি যেখানে আগের বেশ শান্ত লোকটি অনেক বেশি কথা বলেন, অল্পেতে রেগে যাচ্ছেন, রাতে ঘুমাতে চান না, অনেক কাজ করতে চান, হঠাৎ করে ধর্ম কর্ম বেশি বেশি করা শুরু করেন, নিজেকে অনেকে নবীও দাবি করে ফেলেন। সেই রোগীরাই কয়েক দিন ওষুধ খাওয়ার পর দেখি আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছেন।
আর এক প্রকার রোগের কথা না বল্লে আমার লেখা বৃথাই থেকে যাবে, সেটা বিষণ্ণতা। এখানে সবচেয়ে প্রাণচাঞ্চল্য মানুষটি একেবারে মুষড়ে পড়েন, জীবনে সব কিছুই বৃথা হিসাবে দেখেন, জীবনে শুধু পাপ, ভুল ইত্যাদি মনে করেন, অনেকে আত্মহতাও করে বসেন। উপযুক্ত চিকিৎসায় এই রোগীরা আবার প্রাণ ফিরে পান, আবার আশার আলো দেখতে পান।
যারা নেশা করেন তাদের সব কিছুই ঘিরে থাকে শুধুই নেশা। যে মানুষটা আগে স্বাভাবিকই ছিলেন এখন শুধুই নেশার মধ্যে আছেন। নেশা মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞান বিচার বিবেচনা নষ্ট করে দেয়।
আরও অনেক মানসিক রোগ চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে আমার মনে বার বার প্রশ্নটি আঘাত করে, কোন জিনিস আমাদের আচরণে এমন পরিবর্তন আনে। রোগ গুলো নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে বেশ রহস্যের জালে আটকা পড়েছি। হাতে গুনে কয়েকটা রসায়ন একটু বুঝতে চেষ্টা করছি। সেরোটোনিন, ডোপামিন, অ্যাড্রেনালিন, নরঅ্যাড্রেনালিন, এছিতায়িল কলিন, হিস্টামিন এই ছয়টি অতি ক্ষুদ্র রাসায়নিক পদার্থ আমাদের এই সব ব্যবহার, বিশ্বাস, আচরণ সব কিছুর জন্যই দায়ি। আমি আবারও আটকে যাই যখন পাই যে খুব নির্দিষ্ট করে বলা এবং সেটা খুব নির্দিষ্ট করে ঠিক করা বেশ কঠিন। তবে মদ্দাকথা যদি বলতে চাই তাহলে এটা বলতে পারব যে, এই ছয়টি বস্তুর সুন্দর সাম্যাবস্থার জন্যই আমাদের সব কিছুর ভারসাম্য বজায় আছে।
রোগের লক্ষণ, রোগীর আচরণ আর বইয়ের জ্ঞান থেকে এটা বুঝেছি যে সুন্দর ভাবে বাঁচার জন্য আমাদের এই রাসায়নিক ক্রিয়া সঠিকভাবে হওয়া জরুরি। আমার বেশি ভয় করে এটা জানার পর যে এই ক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক হিসাবে আমার ভূমিকা বেশ নগন্য। সুতরাং, বার বার ভাবতে থাকি আমার রসায়ন যদি আমার অজান্তে পরিবর্তন হয় তাহলে আমিও হয়তো আমার পারিপার্শ্বিকতার সাথে বেমানান কাজ বেমালুম করে ফেলবো। আমার সহকর্মীরা হয়তো আমাকে চিকিৎসা দিবেন সেটা আবার ফিরিয়ে আনার জন্য।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleআমি সেক্স এডিক্টটেড
Next articleবিষণ্নতার চিকিৎসা ধৈর্য্যসহকারে বেশ কিছুদিন চালিয়ে যেতে হবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here