কাজ হোক আনন্দময়

কাজ হোক আনন্দময়

শ্রম-শ্রমিক-কর্মকর্তা ও কারখানা সব একই সূত্রে গাঁথা। যেন সবাই একই নৌকার যাত্রী। কারখানা বাঁচলে শ্রমিক বাঁচে, শ্রমিক ভালো থাকলে কারখানায় উৎপাদন বাড়ে। গবেষণা বলছে শ্রমিক বা কর্মীর কাজ যদি আনন্দঘন হয় তবে ১২% উৎপাদন বাড়ে, বিক্রয়কর্মী আনন্দে থাকলে ৩৭% বিক্রি বাড়ে, কর্মস্থল আনন্দের হলে শ্রমিকরা কম ছুটি নেন ও কর্মত্যাগের প্রবণতাও কমে যায়। তাই উৎপাদনের স্বার্থে, দেশের প্রবৃিদ্ধর স্বার্থে শ্রমিকের কাজ ও কর্মস্থল হতে হবে আনন্দের।

শ্রমিকের কাজ আনন্দঘন করার জন্য মালিক, কর্মকর্তা ও শ্রমিক সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। চলুন দেখি কাজ ও কর্মস্থলকে আনন্দঘন করার জন্য আমরা কী কী করতে পারি।

সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্ম পরিবেশ
কর্মক্ষেত্র সুন্দর হলে কাজের মধ্যে সন্তুষ্টি বাড়ে। শরীর ও মন সুস্থ থাকে। তাই শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, গোছালো ও প্রয়োজনীয় আলো-বাতাসপূর্ণ হতে হবে। আর এর জন্য মালিক, কর্মকর্তা ও শ্রমিক সবাইকেই যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে।

বিজ্ঞানসম্মত বিরতি
কাজ ও বিশ্রাম একই মুদ্রার এ-পিঠ ও-পিঠ। কাজের ধরন অনুযায়ী কাজের ফাঁকে সুনির্ধারিত বিরতির ব্যবস্থা করলে কাজ ভালো হবে। আবার এই বিরতিতে বিশ্রামের জন্য বা অন্য কোনো প্রয়োজনে কাউকে যাতে দূরে সরে যেতে না হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। এ সময়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও আনন্দ বিনোদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

সংগীত
পৃথিবীর সব মানুষ সংগীত পছন্দ করে। নিউরো-কগনিটিভ মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন সংগীত মানুষের মস্তিষ্কের বিশেষ কতগুলো জায়গাকে উদ্দীপিত করে। ফলে মানুষ আনন্দিত হয়। শ্রমিকের কাজের সময়ে সংগীত চালু থাকলে কাজের গতি ও মনোযোগ বাড়ে। এছাড়া শ্রমিকের ক্লান্তিবোধ আসে দেরিতে।

যন্ত্রপাতিগুলো মানব প্রকৌশলসম্মত হতে হবে
কাজের সময়ে সবাইকেই কোনো না কোনো যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়। সেই যন্ত্রটা যদি ব্যবহার-বান্ধব হয় তাহলে কাজের পরিমাণ ও গুণগতমান বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীর সব উন্নত দেশে তাদের নাগরিকদের শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যন্ত্রগুলোর ডিজাইন করা হয়ে থাকে। এতে শ্রমিকের যেমন কাজ করতে ভালো লাগে তেমনি গুণগতমান এবং উৎপাদন হার বৃদ্ধি পায়।

বিনামূল্যে খাবার
গবেষণায় দেখা যায়, যেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মকালীন সময়ে বিনামূল্যে খাবার প্রদান করা হয় তাদের শ্রমিকেরা বেশি সন্তুষ্ট থাকে। এক্ষেত্রে শ্রমিকের শরীর ও মন ভালো থাকার সম্ভবনা বাড়ে। সময় নষ্ট হয় না এবং শেষ পর্যন্ত তা কাজের পরিমাণও বাড়িয়ে দেয়। বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা শ্রমিকেরা শ্রম দেয় পারিশ্রমিকের জন্য। তাদের জন্য উপযুক্ত পারিশ্রমিক মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে প্রদান করতে হবে। এতে মালিকের প্রতি শ্রমিকের আস্থা ও বিশ্বাস বাড়ে। পাশাপাশি যাতায়াত, চিকিৎসা, সন্তানদের লেখাপড়াসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা
প্রশিক্ষণ কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। আর দক্ষ শ্রমিক কম কষ্টে ও কম সময়ে বেশি কাজ করতে পারে। দক্ষতা বৃদ্ধি পেলে মানুষ কাজে আনন্দ পায়। যে কাজটা করতে আগে চাপ লাগত দক্ষতা বৃদ্ধি পেলে সেই কাজই মানুষ আনন্দের সাথে করতে পারে। দক্ষতা অনুযায়ী কাজের জায়গা বা ধরন পরিবর্তন অনেক সময়ে একঘেয়েমি কাটাতে সাহায্য করে।

দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ
আবার দক্ষতার উন্নয়ন ঘটালেই শুধু হবে না, দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পেলে মানুষের কর্মসন্তুষ্টি বাড়ে, সাথে উৎপাদনও বাড়ে।

কাজের স্বীকৃিত, পুরস্কার ও পদোন্নতি
প্রতিটা মানুষ তার কাজের স্বীকৃতি চায়। কাজের স্বীকৃতি দিলে মানুষের কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ে এবং কাজটি আনন্দের সাথে করতে পারে। মাঝে মাঝে আর্থিক বা অনার্থিক পুরস্কারের ব্যবস্থা করলে সবার মধ্যে কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। মানুষ তার দক্ষতা বৃদ্ধি করে আরো ওপরের লেভেলে কাজ করতে চায়। তার এই চাওয়াটা পূর্ণ হওয়ার সুযোগ কর্মস্থলে থাকতে হবে। তাহলে সে কাজকে চাপ মনে না করে চ্যালেঞ্জ মনে করবে।

 ‍সুষ্ঠ নিয়ম-শৃঙ্খলা
কর্মস্থলে নিয়ম-শৃঙ্খলা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে সে শৃঙ্খলা হতে হবে সবার জন্য সমান। ধর্ম, বর্ণ, বাসস্থান, নিজ জেলা বা রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে পার্থক্য থাকলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তুষ্টি কাজ করে। একই সাথে কর্ম ফাঁকি দেয়ার একটি প্রবণতা তৈরি হয়। তাই সবার জন্য একই নিয়ম-শৃঙ্খলার ব্যবস্থা করতে হবে।

শ্রমিকরা মহৎ কাজের অংশ
কর্মী বা শ্রমিক কীভাবে একটি বড় ও মহৎ কাজের সাথে যুক্ত আছে তা তাকে বুঝতে সাহায্য করতে হবে। কাজটির গুরুত্ব সঠিকভাবে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তাদের কাজ কীভাবে দেশ ও জাতির জন্য গুরুত্বপর্ণূ তা বুঝিয়ে দিতে হবে। তাহলে শ্রমিক কাজটি করতে যেমন আনন্দ ও গর্ব অনুভব করবে তেমনি কাজের মানও ভালো হবে।

ব্যক্তিগত ও দলগত সমস্যার সমাধান করতে হবে
কর্মস্থল ও কর্মস্থলের বাইরে শ্রমিকের বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত সমস্যা হতে পারে। সে সমস্যাগুলোর কারণে তাদের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটতে পারে। ফলে কাজের গতি কমে যেতে পারে, কর্মস্থলে অনুপস্থিতি বাড়তে পারে ও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই তাদের ব্যক্তিগত ও দলগত সমস্যাগুলো সমাধানে পরামর্শ ও কাউন্সেলিং-সেবা চালু রাখা যেতে পারে।

শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা
আনন্দে থাকার জন্য আমাদের শরীর ও মন ভালো থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্যের কোনো সমস্যা হলে তার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দিলে শ্রমিক ভালো থাকবে এবং প্রতিষ্ঠানও নানাভাবে উপকতৃ হবে। শ্রমিক যত সুস্থ ও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকবে দুর্ঘটনার হারও তত কমবে।

পারিবারিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া
পারিবারিকভাবে শ্রমিক অশান্তিতে থাকলে কর্মস্থলেও তার একটা প্রভাব পড়ে। তাই শ্রমিকদের পারিবারিক সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য উৎসাহ দিতে হবে। সম্ভব হলে আন্তঃপারিবারিক যোগযোগ বৃদ্ধির জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা করা যেতে পারে। যেমন : পিকনিক, খেলাধুলা, সচেতনতা ও মানসিকস্বাস্থ্য বিষয়ের ওপর শিক্ষামলূক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পারিবারিক সম্পর্ক ভালো রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি
মানুষ তার জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় কর্মস্থলে কাটায়। এই সময়টিতে একটি বিশ্বাসের সম্পর্ক না থাকলে সারাক্ষণ এটি অস্বস্তি বা অস্থিরতা কাজ করতে পারে। মালিক-শ্রমিক, কর্মকর্তা-শ্রমিক এবং শ্রমিক-শ্রমিকের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করতে পারলে কর্মপরিবেশ ভালো থাকে। ফলে সবার মধ্যে একটি মানসিক শান্তি কাজ করে। এজন্য একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক-কর্মকর্তা-শ্রমিক সবার মধ্যে সম্পর্ক ও বিশ্বাস উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন : বিভিন্ন তথ্য পরিষ্কারভাবে শ্রমিকেরা যাতে জানতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে, কথা ও কাজের মধ্যে মিল থাকতে হবে, প্রতিশ্রুতি সময়মতো পূরণ করতে হবে ইত্যাদি।

জব সিকিউরিটি
বাংলাদেশের মানুষ বেতন কিছু কম হলেও একটি নিশ্চিন্ত চাকরি চায়। এর মানে হলো যখন তখন চাকরি চলে যাবে এই ভয় থেকে মুক্ত থাকতে চায়। শ্রমিকের মধ্যে যদি এইরকম ভয় থাকে তাহলে শ্রমিক প্রতিষ্ঠানের সাথে একাত্মতা অনুভব করতে পারে না। শৃঙ্খলার জন্য বিভিন্ন ধরনের আর্থিক ও অনার্থিক শাস্তি হতে পারে। তবে যখন তখন চাকরি চলে যাওয়ার ভয়টা শ্রমিকের মধ্যে না থাকাই ভালো।

লেখক: তানজির আহমেদ তুষার, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, সহকারী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleমহামারী এড়াতে তোরজোড়, কিন্তু এই দুঃসময়ে মানসিক চাপ এড়াতে কিছু ভেবেছেন কি?
Next article৮ ঘন্টা কাজ কেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here