আত্মহত্যা ও বাংলাদেশ

সারা পৃথিবীর মত বাংলাদেশেও আত্মহত্যা একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এটা সারা পৃথিবীতে তুলনামূলক কম দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে এবং এটা গবেষকদের কাছে এখনও অবহেলিতই বলা যায়। বাংলাদেশও এর ব্যাতিক্রম নয়, বরং বাংলাদেশে এই সমস্যা আরও প্রকট। আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণা পত্র খুজতে গেলেই বোঝা যায় আমরা কোথায় অবস্থান করছি। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় দশ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে এবং ২০২০ সাল নাগাত তা ১৫ লাখে ঠেকতে পারে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান। দেখা গেছে যে পৃথিবীতে প্রতি ২০ সেকেন্ডে একজন করে আত্মহত্যা করছে এবং ১-২ সেকেন্ডে একজন করে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। এটা ১৫-৪৪ বছর বয়স্কদের মধ্যে মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের মধ্যে একটি, মোট মৃত্যুর ৫ম কারণ এবং তরুণ বয়সে মৃত্যুর প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার সদস্য রাষ্ট্র সমূহকে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করার যথাযত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে।
এশিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম মহাদেশ হওয়ায় মোট আত্মহত্যার ৬০ ভাগ এশিয়াতে ঘটে এবং পৃথিবীর অন্যান্য অবস্থানের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় এর হার বেশি। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ঘন বসতিপূর্ণ উদীয়মান অর্থনীতি যেখানকার মানুষ নিত্যনৈমিত্তিক সংগ্রামের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার বেশ বেশি ও অবহেলিত।  বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে আত্মহত্যা নিয়ে সুসংগঠিত গবেষণা পত্র খুজে পাওয়া বেশ কষ্টকর। যে গুলো পাওয়া যায় তার বেশিরভাগই কোনো একটা বিষয়ের ওপর করা হয়েছে। এখানে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু গবেষণা পত্রের সংক্ষেপণ করা হল।
১) আত্মহত্যার হার: বাংলাদেশে এখনো সারা দেশ জুড়ে আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে বলে পাওয়া যায় নাই। বিদ্যমান গবেষণা পত্রগুলোতে দেখা যায় বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে প্রতি বছরে ৩৯। একই মাফকাঠিতে ৩০ জনের বেশি আত্মহত্যা পাওয়া গেলে তাকে উচ্চ হার হিসাবে ধরা হয়; ১০-২৯ হলে তাকে মাঝারি হার ধরা হয় এবং ১০ এর নিচে হলে তাকে নিম্ন হার ধরা হয়। বাংলাদেশে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া এবং ঝিনাইদহ এলাকায় এই হার সব চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। সারা পৃথিবীতে গরীব দেশ গুলোতে এর হার বেশি পাওয়া যায়।
২) আত্মহত্যার পদ্ধতি: আমাদের দেশে গলায় ফাস এবং কীটনাশক পানের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা ঘটে। সহজলভ্যতা, সামাজিক আচার, প্রথা, গণমাধ্যম সহ আরও বেশ কিছু বিষয়ের উপর এটা নির্ভর করে। এটা যাতে ভিন্ন ভাবে ব্যবহার না হয় সে জন্য এটা নিয়ে বেশি আলোচনা করতে চাই না।
৩) বয়স: বিশ্বের অনেক জায়গায় বয়স্কদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি, সেখানে আমাদের দেশে কর্মক্ষম মানুষের আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। বেশিরভাগ গবেষণা পত্রে দেখা যায় বেশিরভাগ আত্মহত্যা ৪০ বছর বয়সের আগেই ঘটেছে এবং তার মধ্যে আবার ৩০ বছর বয়সের নিচে সবচেয়ে বেশি।
৪) পুরুষ না মহিলা: পৃথিবীর অনেক জায়গায় পুরুষের মধ্যে আত্মহত্যা বেশি হলেও আমাদের দেশে মহিলাদের মধ্যে আত্মহত্যা বেশি পাওয়া গেছে। আমাদের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা দিয়ে সেটা ব্যাখ্যাও করা যায়।
৫) সামাজিক-ডেমোগ্রাফিক বৈশিষ্ট্য: আমাদের দেশে বিবাহিতদের মধ্যে আত্মহত্যা বেশি দেখা গেছে। নিম্নবিত্তদের মধ্যে বেশি; কম শিক্ষিতদের মধ্যে বেশি; গৃহিণী ও কৃষকদের মধ্যে বেশি; আত্মহত্যা ঘটার হার দেখা গেছে। দিনের ২৪ ঘণ্টার শেষ ভাগে অর্থাৎ রাতে বেশি আত্মহত্যা ঘটতে দেখা গেছে এবং প্রায় ৯৮ ভাগ মৃত দেহ নিজের ঘরেই পাওয়া গেছে।
৬) সাম্ভাব্য কারণ: আত্মহত্যার সাম্ভাব্য কারণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে পারিবারিক কলহ। অন্যান্য সাম্ভাব্য কারণের মধ্যে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত, দীর্ঘদিনের রোগ, মানসিক রোগ, নেশা সেবন, দারিদ্রতা সহ আরও কিছু।
৭) মানসিক রোগ: আত্মহত্যার একটা বড় কারণ মানসিক রোগ হলেও আমাদের দেশে আত্মহত্যার সাথে মানসিক রোগের সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য গবেষণা পাওয়া বেশ দুস্কর। তবে যে সব গবেষণা পত্র সাম্ভাব্য কারণ খোজার চেষ্টা করেছে সেখানে কিছুটা ছিটেছাটা হিসাবে পাওয়া যায়।
৮) প্রাপ্ত তথ্য: আমাদের দেশে আত্মহত্যার বেশির ভাগ তথ্য পাওয়া যায় পুলিশ রিপোর্ট, ময়না তদন্ত রিপোর্ট, গণ মাধ্যম সহ আরও কিছু জায়গা থেকে বেশ এলোমেলো ভাবেই। অনেক জায়গায় হেনস্তার ভয়ে তথ্য বিকৃতিও ঘটতে দেখা যায়।
৯) আইনগত দিক: আমাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী আত্মহত্যা ক্রিমিনাল অপরাধ।
আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধ যোগ্য জনস্বাস্থ্য সমস্যা। উপযুক্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে অনেক অসময়ের মৃত্যুকে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
 

Previous articleএকাকীত্ব কাটিয়ে উঠতে যা আপনাকে সহায়তা করতে পারে
Next articleএড়াতে হবে ভালো না লাগা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here