প্রিয়জন-বিয়োগের শোক সর্বজনীন। টমাস অ্যাটিগ তাঁর হাউ উই গ্রিভ: রিলার্নিং দ্য ওয়ার্ল্ড বইটিতে শোক এবং শোকাকুলতার তফাৎ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে শোকাকুলতা আসলে এক ঝাঁক আবেগ যা আমরা নিকটজনকে হারালে অনুভব করি। শোক শুধু তার এক অংশ মাত্র। প্রি়য়জন-বিয়োগে আমাদের নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও, বিয়োগের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া আমরা নির্ধারণ করতে পারি।
আত্মহত্যার কারণে নিজের প্রিয়জনকে হারালে একজন ব্যক্তির আদর্শ ও মানসিক স্থৈর্য ধ্বংস হয়ে যায়। এই সময়টা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর এবং একাকীত্বময় এক সময়। অন্য কারণে মৃত্যুর ফলে নিজের প্রিয়জন মারা গেলে একজন ব্যক্তি যেভাবে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, ঠিক তেমনই অনুভব করেন তিনি যিনি আত্মহত্যায় নিজের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। এই ক্ষেত্রে মাথাব্যাথা, পেট ব্যাথা, ক্ষুধামান্দ্য, মানসিক আঘাত, শব্দ ও আলোর প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা, রক্তচাপ বৃদ্ধি, অনিদ্রা এবং ক্লান্তির মতো শারীরিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
আত্মহত্যায় নিজের প্রিয়জনকে হারানোর যন্ত্রণা, স্বাভাবিক মৃত্যুতে নিজের প্রিয়জন হারানোর মতন হয়েও কোথাও একটা অনেকটাই আলাদা। নিজের মৃত্যু নিজে ডেকে আনাকে, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার স্বাভাবিক আচরণের বিপরীত হিসেবে ধরা হয়। সমাজে এর কোনও স্বীকৃতি নেই বললেই চলে, বৈধতার তো প্রশ্নই ওঠে না। আত্মহত্যাকে ঘিরে কলঙ্ক, লজ্জা, গোপনীয়তা এবং নীরবতা, একে অপরাধ ও পাপের খাতায় ফেলে দেয় যা মৃত ব্যক্তির স্বভাব-চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এই ধরণের আলোচনা মৃত ব্যক্তির শোকার্ত পরিজনদের উপরে গভীর মানসিক প্রভাব ফেলে, এবং তাঁদের পক্ষে এই নিয়ে আলোচনা করা দুষ্কর হয়ে উঠে। ফলে অনেক সময়ই তাঁরা এই বিষয়ে আলোচনা এড়িয়ে যান এবং নিঃশব্দে নিজেকে গুটিয়ে নেন।
“শোকের সাথে এক তীব্র আর্তনাদ”
আত্মহত্যাকে যারা তুলনাহীন মৃত্যু বলেছেন, তাঁরা খুব একটা ভুল বলেননি। এই ক্ষেত্রে প্রি়য়জন-বিয়োগের যন্ত্রণাকে “শোকের সাথে এক তীব্র আর্তনাদ” হিসেবে বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রি়য়জন-বিয়োগের সময় বিভিন্ন আবেগ যেমন রাগ, ভয়, বিষণ্ণতা এবং অপরাধবোধ আরও প্রশস্ত এবং তীব্র হয়ে ওঠে। ফলে শোকাকুল মানসিক অবস্থা আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল হয়ে যায়। তাই হয়ত একে আক্ষরিক অর্থেই জটিল শোক বলা যেতে পারে।
আত্মহত্যা একজনের জীবনে হঠাৎ, হিংস্র এবং অপ্রত্যাশিত ভাবে নেমে আসে। আপনি এই রকম পরিস্থিতির আভাস আগে থেকে পেলেও সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত কোনও দিন হতে পারবেন না। আপনি আত্মহত্যার খবর শুনলে বা মৃতদেহ আবিষ্কার করলে বা আত্মহত্যা করতে দেখলে, অবিশ্বাসে এবং মানসিক শোকে শক্তিহীন হয়ে পড়তে পারেন। স্বাভাবিক ভাবেই এই রকমের অভিজ্ঞতা থেকে আসা মানসিক আঘাত, স্বাভাবিক বা অপঘাতে মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি।
প্রিয়জনকে আত্মহত্যায় হারিয়েছেন এমন ব্যক্তিকে প্রায়ই দু’টো কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়: আমার প্রিয়জন কেন নিজেকে শেষ করে দিলেন? আমি কি এটা কোনও ভাবে আঁচ করতে বা আটকাতে পারতাম? এই চিন্তাগুলি সেই ব্যক্তিকে এক আলাদা রকমের মানসিক কষ্ট, অপরাধবোধ ও গ্লানির দিকে ঠেলে দেয়। আমার ক্ষেত্রে, আমার স্বামীর এই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ বোঝার চেষ্টার সাথে যোগ হয়েছিল প্রত্যাখ্যাত ও একলা হয়ে যাওয়ার অনুভূতি। স্বাভাবিক বা অপঘাতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে আপনাকে এই রকমের আবেগের মুখোমুখি হতে হয় না।
আমাদের সমাজে আত্মহত্যায় কেউ মারা গেলে অন্যান্য মৃত্যুর মতন সমবেদনা এবং সহানুভূতি দেখা যায় না। আমি নিজে এই ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী কারণ, চারপাশে লোকজনদের থেকে সমবেদনা এবং সহানুভূতির অভাবে এক সময় নিজেকে বিচ্ছিন্ন, একলা আর নিঃসঙ্গ মনে করতাম। আমার আত্মীয়রা নিজেরাই দুঃখে ডুবে ছিলেন, কারণ তাঁরা তাঁদের অন্ত্যন্ত কাছের মানুষকে হারিয়েছিলেন। তাঁদের সমবেদনা বা স্নেহ আমার উপরে সেই অর্থে কখনও আসেনি। সেটার কারণ কি আমি জানি না। হয়ত তাঁরাও ঘটনাটায় হতবাক ও বোধশূন্য হয়ে পড়েছিলেন। বন্ধু-বান্ধবদের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। এই রকম বিবেকহীন এবং উদাসীনতার পরিস্থিতিতে, সংবেদনশীলতার অভাব এবং কৌতূহলপূর্ণ আচরণ সবচেয়ে বড় কাঁটা হিসেবে ফুটে ওঠে।
আনুষঙ্গিক শিকার
একটি আত্মহত্যার ঘটনা লাগামছাড়া জল্পনা ও চর্চার জন্ম দেয়। এটি এমন এক প্রকাশ্য ঘটনা যার সাথে জড়িয়ে থাকে প্রচুর ডাক্তারি-আইনি জটিলতা। এই পরিস্থিতিগুলিতে আইনরক্ষকদের অমানবিক ও নাক গলানো আচরণ যেমন মৃত ব্যক্তির বিধ্বস্ত পরিবার পরিজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা লক্ষ্য করা যায়। মূল ঘটনার আনুষঙ্গিক শিকার হিসেবে এভাবেই তাঁদের আবেগগুলো ফুটে ওঠে।
আমাদের চারপাশে আত্মহত্যাকে ঘিরে কুণ্ঠা, গোপনীয়তা, লজ্জা ও নিস্তব্ধতা রয়েছে। মৃত ব্যক্তির পরিবার পরিজনরা অবহিত এবং সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। এই কুণ্ঠা ও লজ্জা আমাদের সমাজের নেতিবাচক আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে সোজা এসে পড়ে সেই হতভাগ্য পরিবারের উপরে। আত্মহত্যা আটকাতে না পারায় নিজের ভূমিকা বাড়িয়ে দেখার প্রবণতা বেড়ে যায়, এবং পাশাপাশি ঝুঁকির কারণগুলির গুরুত্ব কমিয়ে দেখা হয়, যার জন্য আসলে এমনটা হল। কখনও কখনও আলোচনায় মৃত ব্যক্তির ভাল দিকগুলো বাড়িয়ে বলা হয়, যাতে সামান্য সামাজিক স্বীকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়!
আত্মহত্যায় নিজের প্রিয়জনকে হারানোর পর তাঁর পরিবারের লোকজনরা ভয় পান যে তাঁদের প্রিয়জন এবং তাঁদেরকে সবাইকে ভুল বোঝা হতে পারে। এবং সেই আতঙ্কে তাঁরা ক্রমশ নিজেদেরকে চারপাশ থেকে গুটিয়ে নিতে থাকেন। অনেক সময় সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে তাঁরা আসল ঘটনাটা চেপে যান এবং এমন কোনও মৃত্যুর কারণ বলেন যেটা সমাজ মেনে নেবে। সমাজ এবং আশেপাশের লোকদের সাথে এইভাবেই তাঁদের সম্পর্কের বাঁধন ভাঙতে থাকে। এর ফলস্বরূপ, তীব্র মানসিক ধাক্কা থেকে সামলে উঠতে এই অজ্ঞাত এবং অজানা শোকাকুল ব্যক্তিদের অনেকটা সময় লেগে যায়।
যিনি এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন, তাঁর অনেকটা উপকার করা সম্ভব যদি আশেপাশের মানুষ এই বিষয়ে সংবেদনশীল হয়ে উঠেন, সমবেদনার সাথে এগিয়ে আসেন এবং এমন বিরাট ক্ষতির পরে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর কথা মাথায় রাখেন। এটি একটি জটিল পরিস্থিতি যার জন্য প্রয়োজন মানবিক বোধ এবং বিবেচনার; তবে এটা যিনি বেঁচে রয়েছেন তাঁর জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি হয়ে উঠতে পারে।
মূল লেখক: ডঃ নন্দিনী মুরলী, প্রতিষ্ঠতা, স্পিক।