ডা. সুস্মিতা রায়ঃ মিশুর (ছদ্ম নাম) মেজাজটা বেশ খিটখিটে থাকে। যত বড়ো হচ্ছে ততই খিটখিটে ভাবটা বাড়ছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে চায় না। ছোটোখাটো বিষয়ে খুব রাগারাগি ও চেঁচামেচি করে। ছেলেকে নিয়ে মা বেশ চিন্তিত। মিশুর বাবা একটু বদমেজাজি হওয়ায় ছেলের এসব আচরণ তিনি বাবার কাছে চেপে রাখেন। আসলে বাবার সঙ্গে সবসময়ই ছেলের একটু দূরত্ব । বাবা সারাক্ষণই ছেলেকে শাসন করেন। কারণে- অকারণে অকথ্য ভাষায় বকাঝকা, চিৎকার, চেঁচামেচি করেন। এমনকি প্রায়শই তিনি ছেলের গায়ে হাতও তোলেন। মিশুর মায়ের সঙ্গেও চেঁচামেচি করেন। তবে আগে মিশু কখনোই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাত না বা রেগে যেত না! কিন্তু এখন কথায় কথায় রাগ করে। এখন তো ছেলে বাবার মুখে মুখে কথা বলে এমনকি জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে উদ্যত হয়। প্রতিদিন পরিবারে অশান্তি লেগেই আছে। এর প্রভাব মিশুর ছোটো ভাইটির ওপরও পড়ছে। সবসময় হাসিখুশি থাকা প্রাণবন্ত নিস্পাপ শিশুটিও আস্তে আস্তে জেদি ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ছে।
তবে এ ধরনের সমস্যা নিতান্তই একটি পরিবারের নয়। শিশুদের ক্রমান্বয়ে জেদি ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠার কারণ অনেকেই ঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেন না এবং কী করা উচিত তাও বুঝতে পারেন না। এ পর্যায়ে অনেকেই সন্তানকে অতিরিক্ত শাসন শুরু করেন, মারধর করেন কিংবা জেদ মোকাবেলায় বোঝানোর চেষ্টা করেন এবং সন্তান যা কিছু আবদার করে সবটাই পূরণ করেন। কিন্তু সমস্যার কারণ না জেনে শুধু শাসন কিংবা বুঝিয়ে বলাটাই এর সমাধান নয়। শিশুর চরিত্রের মৌলিক গুণাবলি বিকাশে প্রতিকূল পরিবেশের কারণেই কিন্তু তার মানসিক বিকাশ ক্ষুণ্ণ হয়। শিশুকে দেয়া সময়টাকে মানসম্মত ও গুণগত করে তুলতে পারলে সেটা শিশুর বিকাশে অনেক অবদান রাখতে। পারে। একটি শিশুর জন্যের পর থেকে তার বিকাশ প্রস্ফুটিত করতে নানা প্রভাবক দায়ী। শিশুর বিকাশ মূলত দুই ধরনের শারীরিক ও মানসিক। শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিপূর্ণ বৃদ্ধি হলো শারীরিক বিকাশ। আর মানসিক বিকাশ হলো- আচার-ব্যবহার, আবেগ, কথা বলা, চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি, ভাবের আদান- প্রদানের ক্ষমতা অর্জন, বিচার বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি। মানসিক বিকাশ ছাড়া শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। সাধারণভাবে আমরা শিশুর শারীরিক বিকাশে যতটা মনোযোগ দিই, মানসিক বিকাশে ততটা মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি না। কিন্তু মানসিকভাবে সুস্থ না হলে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নেয়। আর শিশুর এসব বিকাশে রয়েছে বংশগত ও পরিবেশগত প্রভাব।
আমরা প্রায়শই বলতে শুনি শিশুটি একেবারেই তার বাবা, মা কিংবা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের মতো হয়েছে। আর এই ‘মতো হওয়া’ মানে শুধুই কি চেহরার মিল? আসলে তা নয়। আচার আচরণ, হাটাচলা, কথা বলার ধরন, যেকোনো পরিস্থিতিতে প্রতিক্রয়া ইত্যাদি সবই এই ‘মতো হওয়া’ এর অন্তর্ভুক্ত। যদিও চেহরার মিল বা শারীরক গঠনের জন্যে বংশগত বা জিনগত কারণ দায়ী, কিন্তু বাকিগুলোর জন্য বংশগত কারণ মোটেই দায়ী নয় । বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, একটি শিশুর মানসিক গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয় মূলত পরিবেশ থেকে অনেকটা দেখে শেখার মতো। একটি শিশু যখন বড়ো হয়, তখন চারদিকের পরিবেশ তাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে এবং এর প্রতিফলন ঘটে তার ব্যক্তিত্বে। শিশুর সামগ্রিক বিকাশের সঙ্গে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা নিবিড়ভাবে জড়িত। আর এ পরিবেশের প্রথম ধাপই হচ্ছে পরিবার। কারণ পরিবারই একটি শিশুর প্রথম শিক্ষালয়। পরিবারের সকল সদস্যই তার শিক্ষক। তাই শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের জন্য পরিবারকেই নিতে হয় সবচেয়ে বড়ো উদ্যোগ। শিশুর সুন্দর ও ভয়হীন শৈশব নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবারের সব সদস্যের। পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে যেভাবে আচরণ করবেন। বা কথা বলবেন শিশুটিও কিন্তু পরবর্তীতে সেভাবেই। আচরণ করবে বা কথা বলবে। কিন্তু পরিবারর বিভিন্ন সমস্যায় যেমন অস্থিতিশীলতা, পারিবারিক কলহ ইত্যাদির ফলে একটি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয় এবং আত্মবিশ্বাস কমে যায়। এতে শিশুর সৃজনশীলতার বিকাশ হয় না। তাই শিশুদের কোনোভাবেই অস্থিশীলতার মধ্যে বাড়তে দেয়া উচিত নয়। ছোটোবেলার অশান্ত পরিবেশ, নেতিবাচক আচরণ তার মনে গেঁথে থাকে চিরদিন। অর্থাৎ পরিবার থেকে শেখা মিথ্যাচারিতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, নির্যাতন কিংবা দুষ্টুমিই তার কাছে চিরস্থায়ী হিসেবে থেকে যায়। বাল্যকাল ও কৈশোরের উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত হলে বড়ো হয়েও সেখান থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারে না। আবার পারিবারিক কলহের চাপে অনেক শিশুর স্বাভাবিক জীবনই অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এ ধরনের ঘটনায় শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেসব শিশু মা-বাবার মনোমালিন্য দেখতে দেখতে বড়ো হয় তারা পরবর্তীতে হতাশ, অসামাজিক ও সহিংস হয়ে ওঠে। নানা অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকে। তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। ফলে মনঃসংযোগের ঘাটতিও দেখা দেয়। মানসিক রোগ ও ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা ঘটতে পারে। গবেষকরা বলেন, শিশুদের ওপর মানসিক আঘাতের প্রভাব অনেক দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষতিকর। যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মানসিক আঘাত শিশুর পরবর্তী জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে, আকোজনিত সমস্যায় আক্রান্ত করে। প্রতিদিন মা-বাবার ঝগড়ার প্রত্যক্ষদর্শী অনেক শিশুর মধ্যে পরবর্তীকালে ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতাও দেখা যায়। সমাজে মানিয়ে চলতে অসুবিধা হয় তাদের।
ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, পারিবারিক কলহের মধ্যে বেড়ে ওঠা অথবা মাকে নির্যাতিত হতে দেখা শিশুরা তাদের শৈশব অবস্থায় অসহায়ত্বে ভোগে এবং এসব শিশুরা পরবর্তীকালে হিংস্র, ঝুঁকিপূর্ণ বা অপরাধমূলক আচরণ করতে পারে। বিষণ্ণতা বা উদবিগ্নতাজনিত রোগ হওয়ার ঝুঁকিতেও পড়তে পারে এসব শিশু। পারিবারিক নির্যাতন দেখে বেড়ে ওঠা শিশুরা এমন ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে যে, অন্যকে আঘাত করা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। সে যে কাউকে আঘাত করতে পারে। আবার সে-ও অন্যের কাছ থেকে আঘাত পেতে পারে। তাই বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই তাদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
কাজেই শিশুর জন্মের পর থেকেই শিশুর বিকাশ প্রস্ফুটিত করার লক্ষ্যে একটি পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। শিশুকে দেয়া সময়টাকে মানসম্মত করে তুলতে পারলে সেটা শিশুর বিকাশে অনেক অবদান রাখতে পারে। মনে রাখতে হবে, পরিবারের ধরন থেকেই শিশুর পরবর্তী বিকাশ হয়, বড়োদের সঙ্গে তার সখ্য বাড়ে, অন্যদের সঙ্গে তার যোগাযোগের দক্ষতা তৈরি হয় এবং পারিবারিক রীতিনীতি সম্পর্কেও সে স্পষ্ট ধারণা পায়। যার ফলে পারিবারিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। কাজেই আমরা একটি শিশুর কাছ থেকে যে ধরনের আচরণ ও মূল্যবোধ আশা করি, তাকে ঠিক সে ধরনের পরিবেশ সমৃদ্ধ পরিবারেই বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
ডা. সুস্মিতা রায়
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মানসিক রোগ বিভাগ
জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজ, সিলেট
উক্ত নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশিত। প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।