সিজোফ্রেনিয়া : একা একা কথা বলা বা অদৃশ্য স্পর্শ অনুভব

সিজোফ্রেনিয়া কী ?

সিজোফ্রেনিয়া একটি বহুল পরিচিত স্নায়বিক-মানসিক রোগ। রোগটার নাম মূলত স্কিকৎজোফ্রেনিয়া। যেটাকে অনেকে সিজোফ্রেনিয়া নামেই চেনে। এটা এমন একটা মনোব্যাধি যেটা হলে মানুষ বুঝতে পারে না কোনটা সত্যি আর কোনটা কল্পনা। বিশ্বের এক শতাংশের কিছু কম মানুষ এ রোগটিতে ভুগছেন।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের দ্বৈত সত্তা থাকে, তারা বিপজ্জনক ও উগ্র হয়ে ওঠেন। তবে এসব ধারণা মোটেই সঠিক নয়। এটা ঠিক যে রোগী কখনো কখনো ভীতিকর কোনো কাজ করতে পারে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে একই উপসর্গ দেখা যায় না। একেকজনের আচরণ একেকরকম হয়ে থাকতে পারে।

তবে সিজোফ্রেনিয়াকে এখনো খুব ভালো করে ব্যাখ্যা করা যায়নি। কিশোর বা যুবা বয়সের শুরুতে রোগটির আক্রমণের সময় আক্রান্ত ব্যক্তি বা চিকিৎসক বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একে উদ্বেগ বা বিষণ্ণতার লক্ষণ ভেবে ভুল করেন।

রোগের মাত্রা বাড়তে থাকলে রোগী আকস্মিক বা নিয়মিত হ্যালুসিনেশনে ভোগেন। অনেকের কথাবার্তা ও চিন্তাভাবনায় অসংগতি দেখা যায়।

সিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত অনেক মানুষের- সমাজে, স্কুলে, অফিসে, পারিবারিক সম্পর্কে – মেলামেশা অসম্ভব হয়ে পড়ে। মনে মনে সারাক্ষণ নিরানন্দ জেঁকে বসে। কেউ কেউ আবার নিজেদের আবেগকে প্রকাশ বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।

এ রোগীরা সবসময় ভয়ে ভয়ে এবং পশ্চাত্পদে থাকে। যদিও সিজোফ্রেনিয়া সম্পুর্ণ নিরাময় করা যায় না, তবে সঠিক চিকিৎসার দ্বারা এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

রোগের চিকিৎসার জন্য একটা গাইডলাইন করেছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইক্রিয়াট্রিস্ট। গাইডলাইন তৈরির ওয়ার্কিং কমিটি সদস্য ডা. মো. ফারুক হোসেন বলেন, এই

রোগের কিছু লক্ষণ এমন :

১. রোগী এমন কিছু শুনতে পায় বা দেখতে পায় যেটা বাস্তবে থাকে না
২. কথা বলা বা লেখায় অদ্ভুত বা অযৌক্তিক ধরন বা আচরণ
৩. গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে উদাসীন বোধ করা
৪. নিজের যত্ন নেয়ার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়া
৫. কোনো কাজে মনযোগ না থাকা
৬. আবেগ, অনুভূতি কমে যাওয়া।

সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার কারন :

এই রোগের সঠিক কারণ জানা যায়নি। তবে, যে যে কারণগুলিকে এই রোগের জন্য দায়ী করা হয়, সেগুলি হল- জেনেটিক কারণ, পরিবেশগত কারণ, ব্রেইন সমস্যাগত কারণ।

গবেষকরা সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার পিছনে ভুমিকা পালন করে এমন কয়েকটা ফ্যাক্টরকে উন্মোচিত করেছেন :

*জেনেটিক্স (বংশগত):
বংশগতভাবে এই রোগ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও তা দেখা যায়। চিকিৎসকরা বলছেন জেনেটিক ইনফ্লুয়েন্স থাকে ৮০ শতাংশ। বাবা- মা দুজনের এই রোগ থাকলে সন্তানের হওয়ার সম্ভাবনা ৪০গুণ বেড়ে যায়। জমজ বাচ্চার একজনের থাকলে আরেকজনের ঝুঁকি ৫০ গুণ বেশি থাকে।

এছাড়া সন্তান মাতৃগর্ভে থাকার সময় কোন সমস্যা হলে বা জন্মের সময় কোন ক্ষতি হলে বা অক্সিজেনের অভাব হলে এই রোগ হতে পারে।

*ব্রেইন কেমিস্ট্রি এবং সার্কিটস :
এই রোগ থাকা মানুষের ব্রেইনে কিছু কেমিকেল অনিয়মিত থাকতে পারে যেটা চিন্তা এবং আচরণের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

* ব্রেইনের অস্বাভাবিকতা :
গবেষণায় Schizophrenia তে আক্রান্ত মানুষের ব্রেইনে কিছু অস্বাভাবিক গঠন খুজে পাওয়া গিয়েছে। তবে এই অস্বাভাবাকিতা Schizophrenia তে আক্রান্ত সকল মানুষের থাকে না এবং এই রোগে আক্রান্ত না এমন মানুষেরও এই অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে।

* পরিবেশগত কারণ :
ভাইরাস সংক্রমণ, টক্সিনের আশেপাশে সময় ব্যায় করা, অত্যন্ত চাপগ্রস্থ পরিস্থিতি ইত্যাদির কারণে Schizophrenia হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। শরীর যখন হরমোন অথবা শারীরিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় – যেমন কিশোর বয়স – তখন Schizophrenia এর উপসর্গ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বেশি।

চিকিৎসা কী :

ডা. মো. ফারুক হোসেন বলেন ওষুধ দিয়েই মূলত রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ‘প্রথমে এ্যান্টি সাইকোটিক মেডিসিন, এরপর সাইকোথেরাপির দিকে যেতে হয়। ৮০ভাগ রোগী কিছু দিন ভালো, কিছু দিন খারাপ থাকে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভালো হয় না। বাকি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ঠিক হয়ে যায়।’

তিনি বলেন , এই রোগীদের মৃত্যুর হার বেশি কারণ তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। ‘পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ সুইসাইড করে।’

সিজোফ্রেনিয়া এর উপসর্গ/প্রকারভেদ:

সিজোফ্রেনিয়া এর কমন উপসর্গগুলোকে তিনটি বিভাগে – পজিটিভ উপসর্গ, কগনিটিভ উপসর্গ এবং নেগেটিভ উপসর্গে – ভাগ করা যায়।

পজিটিভ উপসর্গ :

এখানে পজিটিভ দিয়ে “ভালো” বোঝানো হচ্ছে না। বরং ডিসঅর্গানাইজড বা অতিরঞ্জিত চিন্তাভাবনা এবং ব্যবহার যেটা বিচারশক্তিহীন হয়ে যায় সেটা বোঝানো হচ্ছে। পজিটিভ বা ডিসঅর্গানাইজড উপসর্গের কয়েকটা উদাহরণ হচ্ছে-

* কথায় আবোল-তাবোল শব্দ ব্যবহার করা। এমন কথা বলা যা অন্যান্যরা ঠিকভাবে বুঝতে পারে না
* খুব দ্রুত চিন্তা বদলানো
* সিদ্ধান্ত নিতে না পারা
* দ্রুত ভুলে যাওয়া বা জিনিসপত্র হারানো
* চলাফেরা অথবা অঙ্গভঙ্গির পুনরাবৃত্তি করা
* দৈনন্দিন দৃষ্ট বস্তু, শব্দ এবং অনুভূতি ঠিক মতো বুঝতে না পারা

কগনিটিভ উপসর্গ :

কগনিটিভ উপসর্গ হলো কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলা। কগনিটিভ উপসর্গের কয়েকটা উদাহরণ হচ্ছে-
* ঠিকমতো তথ্য বুঝে, চিন্তা করে কাজ করতে না পারা
* মনোযোগ দিতে না পারা
* কোনো তথ্য মুখস্থ করার সাথে সাথে সেটা কোন কাজে ব্যবহার করতে না পারা

নেগেটিভ উপসর্গ :

এখানে নেগেটিভ দ্বারা ‘খারাপ’ বোঝানো হয় না। বরং সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির সাধারণ কিছু ব্যবহারের অনুপস্থিতিকে বোঝানো হয়। সিজোফ্রেনিয়া এর নেগেটিভ উপসর্গের কয়েকটা উদাহরণ হচ্ছে:

* আবেগের অনুপস্থিতি অথবা খুব সীমিত পরিসীমার আবেগ
* পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের সাথে না মেশা এবং সামাজিক ক্রিয়াকালাপে অংশগ্রহণ না করা
* কথাবার্তা কমে যাওয়া
* জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া
* শরীরের যত্ন না নেওয়া

কাদের সিজোফ্রেনিয়া হয়?

সিজোফ্রেনিয়া যে কোনো মানুষের হতে পারে। নারী এবং পুরুষ উভয়েরই এটা সমানভাবে হয়। এটা সব বয়সেই হতে পারে। সিজোফ্রেনিয়া এর উপসর্গ সাধারণত পুরুষদের কিশোর বয়সে অথবা ২০-২২ বছর বয়সে এবং নারীদের ২৫-৩৫ বছর বয়সে প্রথম দেখা দেয়।

যদি সিজোফ্রেনিয়া অল্প বয়সে হয় তাহলে বয়স বেশি হলে এটা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ৫ বছরের বেশি বয়সী বাচ্চাদের এটা হতে পারে। তবে কৈশোরের আগে এটা হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম।

সংকলন ও সম্পাদনা : শাহনূর শাহীন
সূত্র : প্রথম আলো, যুগান্তর, বিবিসি, উইকিপিডিয়া

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে 

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪

/এসএস

VIAসিজোফ্রেনিয়া
SOURCEসিজোফ্রোনিয়া
Previous articleমাঙ্কিপক্স নিয়ে যা জানা প্রয়োজন
Next articleসিজোফ্রেনিয়া : ভূতের আঁচড় নাকি মানসিক রোগ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here