শিশু আক্রমণাত্মক মানসিক রোগী হলে নিয়ন্ত্রণের উপায়

ডা. মাহজাবিন আফতাব সোলায়মান

মৌখিক নির্যাতন বা শারীরিক আগ্রাসনকে একীভূত করে আক্রমণাত্মক আচরণগুলো শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, অটিজম, অতিচঞ্চলতা, সংহতিনাশক আচরণগত সমস্যা, শেখার বিশৃঙ্খলা বা আগ্রাসনের পূর্ব-ইতিহাস সম্পন্ন শিশুদের ক্ষেত্রে আগ্রাসনের হার বেশি। আক্রমণাত্মক আচরণ পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, সমবয়সী বন্ধু-বান্ধব, হাসপাতালকর্মী এবং শিশুর নিজের সুরক্ষার জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে এবং বাড়ির চিকিৎসাজনিত পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে বিপদগ্রস্ত করে তুলতে পারে।

তদানুসারে আগ্রাসনকে কার্যকর উপায়ে ও কৌশলের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গুণগত চিকিৎসাসেবা সংস্থানে একটি মৌলিক প্রয়োজন হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

আগ্রাসনের গতানুগতিক ধারার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে রোগী কেন্দ্রিক কারণই উচ্ছঙ্খৃল আচরণের অন্যতম উপাদান হিসেবে পরিগণিত হয়। এতে শিশুর মানসিক রোগকেই আক্রমণাত্মক আচরণের কার্যকারণ ধরা হয়।

পরিবেশগত কারণ যেমন, পরিবারের সদস্য বা হাসপাতাল কর্মীদের আচরণ, বাড়ির ও হাসপাতালের পারিপার্শ্বিকতাও আক্রমণাত্মক আচরণ প্রকাশে অন্যতম অবদান রাখে।

আগ্রাসন আক্রমণ নিরসন

এ জন্যই আগ্রাসনের অতিরিক্ত বহিঃপ্রকাশ নিরসনে শিশুর অন্তর্নিহিত রোগের ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি রোগী কেন্দ্রিক কার্যকরী পন্থা ও কৌশলের সাহায্য নিতে হয়। কৌশলগত পন্থার স্থিতিমাপ অনুসারে প্রতিরোধ কৌশল শিশুকে দুর্দশা ও সংঘাতময় পরিস্থিতির মোকাবিলায় দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করতে পারে।

এই কৌশলগুলো শিশুর মৌলিক অবস্থা মূল্যায়নের পাশাপাশি রোগ ত্বরান্বিতকরণের কারণ শনাক্তকরণ, স্বতন্ত্র চিকিৎসা পরিকল্পনা, শারীরিক পরিবেশের উন্নতি, ক্রোধদমন, আন্তঃবিষয়ক সহযোগিতা, পারিবারিক অংশগ্রহণ, কর্মী প্রশিক্ষণ, ধারাবাহিক ওয়ার্ড কার্যক্রম ও সীমাবদ্ধ উপায়ে সংযম প্রভৃতির গুরুত্বকে জোরদার করে।

শিশু মানসিক রোগীর আক্রমণাত্মক আচরণ নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে ব্রড-বেইজড বিহেভিয়ারাল ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম বা ব্যাপকভিত্তিক আচরণগত ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য।

এটি একটি ব্যাপক বোধশক্তি সম্পন্ন আচরণগত ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম। শিশুর আক্রমণাত্মক আচরণের হার হ্রাসের মাধ্যমে পরিবারের সদস্য, হাসপাতালকর্মী ও শিশুর নিজের জন্য একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত চিকিৎসার পরিবেশ সরবরাহ করা এই কার্যক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

এই নীতির ভিত্তি হলো, সহজলভ্য চিকিৎসা-নির্দেশিকা ও ইতিবাচক প্যারেন্টিং কার্যক্রম যা তিনটি প্রাথমিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। যেমন:

. স্টাফ বা কর্মী প্রশিক্ষণ

প্রতিরোধ এবং প্রাথমিক হস্তক্ষেপের পাশাপাশি গ্রহণযোগ্য পুরস্কার ও রোগীর আচরণের পরিণতিগুলোর ওপর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোর দেয়। এর মাধ্যমে পর্যাপ্ত দক্ষতার সঙ্গে ও ধারাবাহিকভাবে আচরণ বাবস্থাপনার কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়।

. রোগীর স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা

স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা রোগীর যত্নের দুটি দিকের ওপর লক্ষ রাখে। প্রত্যেক শিশুর জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপনা পরিবারের সদস্য ও শিশুর নিজের মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের দ্বারা পরিকল্পনা করা হয়। আলোচিত বিষয়গুলো হচ্ছে:

১. আগ্রাসী আচরণের সম্ভাব্য কারণ শনাক্তকরণ

২. অভিযুক্ত আচরণ দমন করতে বাড়িতে ব্যবহৃত পদ্ধতি

৩. আগ্রাসী আচরণের যৌক্তিক ও অনুমানযোগ্য পরিণতি

৪. জ্ঞানীয় আচরণ বিদ্যা

জ্ঞানীয় আচরণ বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত আলোচিত বিষয়গুলো হলো:

রাগদমন ব্যবস্থাপনা

অভ্যন্তরীণ সংবেদনশীলতার উপলব্ধি, হঠকারী কারণ শনাক্তকরণ ও স্ব স্ব নিয়ন্ত্রণ-কৌশলের বিকাশ।

সমস্যা সমাধানের দক্ষতার প্রশিক্ষণ

সমস্যা ও দ্বন্দ্ব শনাক্তকরণ, নাটিকা রচনা ও প্রদর্শন এবং প্রতিক্রিয়া মঞ্চায়নের নির্দেশনা

. আচরণগত ব্যবস্থাপনার জন্য মানসম্মত কাঠামো

এই ধারার অন্তর্নিহিত নীতি হলো যথাযথ আচরণের প্রতি জোর দেওয়া এবং আগ্রাসী ও বিপজ্জনক আচরণকে নিবারণ করা।

যথাযথ আচরণ জোরদারকরণ

মৌখিক উৎসাহ, স্টিকার চার্ট ও শিশুর জন্য অন্যান্য অর্থপূর্ণ পুরস্কার শিশুর যথাযথ আচরণকে শক্তিশালী করে।

আগ্রাসী আচরণ প্রতিরোধকরণ

বিঘ্নিত আচরণ ও আগ্রাসন ব্যবস্থাপনার জন্য ন্যূনতম সংবরণ- পদ্ধতি ও অন্যান্য বিকল্প পদ্ধতির ব্যবহার শ্রেণিবিন্যাসের মাধ্যমে করা হয়।

আচরণ ব্যবস্থাপনার কাঠামো

পছন্দসই আচরণের মাধ্যমে রোগীকে যথাযথ আচরণে সংলগ্ন রাখা, অযাচিত আচরণের ফলস্বরূপ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত ঘরে আলাদা রাখা, স্বতন্ত্র করা ও নির্জনে রাখা এবং হাসপাতাল কর্মী দ্বারা সীমিত পরিসরে শারীরিক সংযম ও শিরাপথে বা মাংসে উত্তেজনা প্রশমনের ঔষধ প্রদান।

নতুন কৌশলটির প্রভাব মূল্যায়নের পাশাপাশি অন্যান্য বিকল্প ব্যবস্থা ব্যবহারের হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস করা বাঞ্ছনীয়। এর ফলে পরবর্তীতে নিম্নলিখিত ঘটনা বা পদ্ধতিগুলো এড়ানো এবং ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব। যেমন:

১. আক্রমণাত্মক ঘটনা

২. পরিবারের সদস্য, হাসপাতাল কর্মী ও শিশুর নিজের আঘাত

৩. নিরাপত্তা কর্মীর নিযুক্ততা (ক্রমান্বয়ে হ্রাস করা)

৪. সীমিত পরিসরে শারীরিক সংযমের ব্যবস্থা

৫. প্রয়োজন অনুযায়ী নিঃসঙ্গতার ব্যবস্থা

৬. প্রয়োজন অনুযায়ী স্বতন্ত্রকরণ

৭. প্রয়োজন অনুযায়ী ঘুমের ঔষধ প্রদান ইত্যাদি

The Health of the Nation Outcome Scales for Children and Adolescent (HoNOSCA):

এটি হলো মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিন্যাসে ব্যবহারের জন্য উদ্ভাবিত বিশ্ববাপী মানসিক সমস্যার তীব্রতা নির্ণায়ক একটি সংক্ষিপ্ত ও চিকিৎসক দ্বারা নির্ধারিত মাপক বিশেষ। এটি শিশুর আবেগীয় ও আচরণগত সমস্যার তীব্রতা নির্ণায়ক একটি নির্ভরযোগ্য সূচক। দৈনন্দিন উন্নতি বা অবনতি পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবে HoNOSCA ১৩তম ইউনিটের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়।

সুতরাং, ওপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ব্যাপকভিত্তিক আচরণগত ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম বা ব্রড- বেইজড বিহেভিয়ার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম শুধুমাত্র আক্রমণাত্মক আচরণই নিয়ন্ত্রণ করে না বরং একটি পরিসীমায় অন্যান্য সুবিধাও প্রদান করে।

শারীরিক সংযতকরণ সম্ভবপর করে ও এর ফলে ঘটিত জখমের হারও গ্রাস করে। এটি রোগী-কেন্দ্রিক নির্দিষ্ট চিকিৎসা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ঝকিুঁ ব্যবস্থাপনার সাংগঠনিক পদ্ধতির গুরুত্বকেও সমর্থন করে।

ডা. মাহজাবিন আফতাব সোলায়মান

সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ মেডিক্যাল কলেজ।

Previous articleবেঁচে থাকার জন্য ভালোবাসা জরুরি : শিমুল মুস্তাফা
Next articleকরোনা ভ্যাকসিন গ্রহণের নেপথ্যে থাকা কিছু ভুল ধারণা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here