শিশুদের আত্মমর্যাদাবোধ তৈরিতে পিতা-মাতার ভূমিকা

সহজ কথায় ‘আত্মমর্যাদাবোধ’ বলতে নিজের সম্পর্কে ভালো বোধ করা, নিজেকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারাকে বোঝায়। ব্যক্তির জীবনে নিজেকে নিজে ভালো জানা ও ব্যক্তি যা তাই হিসাবে নিজেকে গ্রহণ করতে পারার মূল্য অনেক বেশি। এর অভাবে ব্যক্তি হীনমন্যতায় ভুগতে পারে; ব্যক্তির ভেতর যেকোনো বিষয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাব হতে পারে; অনেক ছোটো বিষয় তার কাছে অনেক কঠিন বলে মনে হতে পারে।

আত্মমর্যাদা বোধের অভাবে ব্যক্তির মধ্যে সবকিছু নিয়ে নেতিবাচকভাবে দেখা, রাগ নিয়ন্ত্রন করতে না পারা, লজ্জা, ভয়, নিজেকে অন্যের কাছে অহেতুক বড় করে দেখানোর প্রবণতা সৃষ্টি হয়, যা তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। ফলে ব্যক্তি নিজে এবং তার কাছের লোকজন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই আত্মমর্যাদাবোধ গড়ে উঠে শিশু বয়স থেকেই।

আমরা জানি পরিবার সকল শিক্ষার মূলভিত্তি। তাই শিশুর আত্মমর্যাদা তৈরিতে পরিবারের বিশেষ করে পিতামাতার ভূমিকা অনস্বীকার্য।

নিম্নে শিশুর আত্মমর্যাদা তৈরিতে পিতামাতা যা করতে পারেন সে বিষয়ে সংক্ষিপ্তে কিছু কথা তুলে ধরা হলো-

– শিশুকে তার ভালো কাজ, ভালো গুণ, ভালো ব্যবহারের জন্য প্রশংসা করুন।কখন কখনো বিনা শর্তে শিশুকে ভালবাসা প্রদর্শন করুন। আপনার জীবনে তার গুরুত্ব সম্পর্কে তাকে ভালো অনুভব করতে দিন। সে অনেক ভালো , তাকে আপনি পছন্দ করেন, এমনটি নিজে বলুন বা তার সামনে অন্য কাউকে বলুন। এতে তার মনে নিজের গুণের ব্যপারে আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে, নিজেকে মূল্যায়ন করতে শিখবে। তবে অযথা ভুল আচরণে বাড়াবাড়ি রকমের আদর প্রদরশন করবেন না।

– শিশুর মধ্যে কোনো দুর্বলতা থাকলে তা সহজভাবে গ্রহণ করে নিন এবং শিশুকে বলুন সবার মধ্যে সব গুণ থাকে না, কেউ গানে ভালো তো কেউ খেলায় ভালো। সবাই সব কিছু পারবে এটা সব সময় হয় না। তার পরিবর্তে সে যা ভালভাবে পারে তা ইতিবাচকভাবে তুলে ধরুন। এতে তার মধ্যে কোনো বিষয় না পারার প্রতি কোন হীনমন্যতা তৈরি হবে না এবং না পারা খুব খারাপ কিছু বলে সে নিজেকে অবমূল্যায়ন করবে না।

– শিশুকে ছোট বেলা থেকে বিশেষ করে ৪ বছর বয়স থেকে ছোটো ছোটো দায়িত্ব দিন। যেমন-খেলনা গুছিয়ে রাখা, নিজের কাপড়-চোপড় গুছিয়ে রাখা। এবং আস্তে আস্তে তার বয়স উপযোগী পরিবারের কিছু দায়িত্ব পালন করতে দিন। যেমন- দোকান থেকে কিছু এনে দেয়া, মেহমান আসলে আপ্যায়ন করতে মায়ের কাজে সাহায্য করা, দাদুর ওষুধের কথা মনে করিয়ে দেয়া ইত্যাদি। এভাবে বয়সের সাথে সাথে তাকে কিছু সামাজিক দায়িত্ব ও দিন। যেমন-প্রতিবেশিদের সাথে দেখা হলে সালাম দেয়া, রাস্তায় কলার খোসা পড়ে থাকতে দেখলে তা ডাস্টবিনে তুলে ফেলার মতো দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে বুঝিয়ে বলুন।

শিশুর সামনে পিতামাতাও এইসব দায়িত্ব পালন করবেন। ব্যক্তির সাধ্য অনুযায়ী ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করলে ব্যক্তির মধ্যে নিজের প্রতি মর্যাদাবোধ তৈরি হয়।

– শিশুকে নিজের সম্পর্কে, অন্যদের সম্পর্কে এবং বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ইতিবাচক চিন্তা করতে উৎসাহিত করবেন। শিশুর সামনে নেতিবাচকভাবে সবসময় ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা ত্যাগ করা প্রয়োজন। শিশুরা সাধারণত বড়দের কাছ থেকে দেখে বেশি শেখে। তাই ঘটনাকে নেতিবাচকভাবে ব্যাখ্যা করলে পরবর্তীতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে অধিকাংশ সময়ই শিশুদের ও ঘটনাকে নেতিবাচকভাবে দেখার প্রবণতা তৈরি হয়। ধরা যাক, আপনার শিশুর সাথে অন্য একটি শিশু স্কুলে খুব খারাপ আচরণ করেছে। আপনি যদি বলেন, শিশুটি বেয়াদব। তার বাবা-মা তাকে কিছুই শিখায়নি। তাহলে শিশুটি অন্য বাচ্চাদের চেয়ে নিজেরকে বড় কিছু মনে করতে পারে এবং অন্যকে হেয় করার প্রবনতা তৈরি হতে পারে। তার পরিবর্তে বলতে পারেন, শিশুটি হয়ত বুঝতে পারেনি। সাথে সাথে নিজের শিশুটিকেও সমবেদনা জানাতে হবে। তাতে শিশুটির নিজের প্রতি সঠিক ধারণার পাশাপাশি অন্যকে সে সহজেই নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করবে না। এভাবেই কিছুটা সচেতন হলেই আমরা পিতা-মাতারাই পারি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আত্মমর্যাদাশীল করে গড়ে তুলতে।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনেরখবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোন দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleখেলাধুলা মনের খোরাক
Next articleমন ও শিক্ষা
সহকারী অধ্যাপক(ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি) মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here