বাংলাদেশের প্রায় ৯২% মানুষ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। এর নানামুখি কারণ রয়েছে। যেমন- প্রান্তিক পর্যায়ের বেশীরভাগ মানুষ তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন নয় বা তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কোনো কার্যকরী পদক্ষেপও নেই। আবার আর্থ-সামাজিক কারণেও অনেকের এই সেবার অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে না। মানসিক রোগের বিভিন্ন অপচিকিৎসা এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে সেবা গ্রহণের বৈষম্য নিয়ে লিখেছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার।
সব ধরনের উদ্দীপনাতেই আমাদের মন, স্নায়ুতন্ত্র ক্রমে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। ব্যতিক্রম ব্যথার উদ্দীপনা। আর যার ব্যথা সে-ই বুঝে। ‘কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে’। বৈষম্য এমনি এক মনো-সামাজিক উদ্দীপনা, বৈষম্যপীড়িত জনই যা হাড়ে হাড়ে টের পান। বৈষম্য বহুবিধ : ধনবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, ধর্মবৈষম্য, বর্ণবৈষম্য, জাতিবৈষম্য, ইত্যাদি। আমাদের দেশে ধনবৈষম্য ও লিঙ্গবৈষম্য সর্বত্র ব্যাপ্ত। আমি সব বৈষম্যের সেরা বৈষম্য ধনবৈষম্য নিয়েই বাগবিস্তার করব। সামগ্রিকভাবে বিশ্বের ধনবৃদ্ধি ঘটে চলেছে। কিন্তু তা ঘটছে ধনী ও নির্ধনের ধনবৈষম্য বাড়িয়ে বাড়িয়ে। এই শুভংকরের ফাঁকিটি বড়ো নির্লজ্জভাবে উদাম করে দিচ্ছে করোনা। মহামারি। গরীব দেশের কথা বাদ দিয়ে ধনী দেশের কথাই বিবেচনা করা যাক। সেখানেও দেখি আক্রান্তের হার, মৃত্যুর হার দুই দিকেই বৈষম্যপীড়িত জনতা সুবিধাভোগীদের অনেক ছাড়িয়ে গেছে। (দেখুন : Inequality’s Deadly Toll, Nature, Vol 592, 29 April 2021) বৈষম্যটি টিকা পাওয়ার বেলাতেও কার্যকর। ধনী দেশগুলো যেখানে বুস্টার ডোজ দেয়া শুরু করেছে, সেখানে গরীব দেশগুলোর মানুষ প্রথম ডোজই পাচ্ছেন না। মানসিক স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে জড়িতদের মনটি সংবেদনশীল। তাই তারা এবার বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য করেছেন, ‘বৈষম্যপূর্ণ বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ধনবৈষম্যের প্রভাব
যদি আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ধনবৈষম্যের প্রভাব বিবেচনা করি, তাহলে দেখব মানুষকে রোগপ্রবণ হিসাবে গড়ে তোলা, রোগের প্রকাশ ঘটানো, এবং রোগকে জিইয়ে রাখা; সব পর্যায়েই ধনবৈষম্য কাজ করে চলে। শুরুতে আসা যাক মানুষকে মানসিক রোগপ্রবণ হিসাবে গড়ে তুলতে ধনবৈষম্যের প্রভাব নিয়ে। গরীব অন্তঃসত্ত্বা অপুষ্টিতে ভোগে, গর্ভের সন্তানও তার দায় বহন করে। প্রসবকালীন সেবাও তাদের ভাগ্যে জোটে না, প্রসবকালীন জটিলতার ফলাফল সন্তানে বর্তায়। শিশুর বেড়ে উঠার সময় অপুষ্টি, বিভিন্ন রোগ, তুলনামূলকভাবে নিঃস্ব সামাজিক- সাংস্কৃতিক পরিবেশ, তার শারীরিক মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে শিশুটিকে মানসিক রোগপ্রবণ হিসাবেই গড়ে তোলে। এসব শিশুর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সীমিত। তাদের শৈশব-কৈশোরের দ্রুতই অবসান ঘটে। তারা অপরিণত অবস্থাতেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। মেয়েদের বাল্য- বিবাহের ঘটনা ঘটে গরীব পরিবারগুলোতেই। তাদের জীবিকা অনিশ্চিত। কর্মের পরিবেশ স্বাস্থ্যের অনুকূল নয়। কাজের চাপ বেশি। দরিদ্ররা শুধুমাত্র পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য এবং স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান থেকেই বঞ্চিত হয় না। তাদের বাসস্থানের পরিবেশ এবং কাজের দীর্ঘ সময়-এ দুয়ে মিলে তাদেরকে পরিপূর্ণ ঘুমের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করে। (দেখুন: The great sleep divide: https://knowablemagazine.org/article/ health- disease/2021/the-great sleep-divide) এসব কিছুই মনো-সামাজিক চাপ হিসাবে কাজ করে রোগপ্রবণদের মধ্যে মানসিক রোগের প্রকাশ ঘটায়। গরীবদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার সীমিত। মানসিক রোগ সম্বন্ধেও তাদের ধারণা নাই, কিংবা থাকলেও তা ভ্রান্ত। এই অজ্ঞতার কারণে কিংবা আর্থিক অসামর্থের জন্য তারা মানসিক রোগের চিকিৎসা করায় না। কিংবা মানসিক রোগকে উপরি পাওয়া, জ্বিনে ধরা ইত্যাদি ভেবে ওঝা কবিরাজের শরণাপন্ন হয়। অন্যদিকে মানসিক রোগের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থাও তাদের নাগালের বাইরে। তাই গরীবদের মানসিক রোগ অচিকিৎসায় বা অপ-চিকিৎসায় দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়।
করণীয় কী?
ধনবৈষম্যই বলি কিংবা লিঙ্গবৈষম্যই বলি, সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ম। আমরা পেশাজীবীগণ সমাজ ও রাষ্ট্রের অংশ হিসাবে তাতে অংশ নিতে পারি। এবারের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে “বৈষম্যপূর্ণ বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’ প্রতিপাদ্য হিসাবে গ্রহণ করার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীগণ বৈষম্যের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছেন। সামাজিক পরিবেশের ইতিবাচক পরিবর্তন না করে শুধুমাত্র রোগ চিকিৎসার মাধ্যমে কোনো সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবু মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে যে বৈষম্যসমূহ বিরাজমান, যদি আমরা সেসবকে চিহ্নিত করে দূরীকরণে উদ্যোগী হই, তাতে বৈষম্যের শিকারদের যন্ত্রণা লাঘবে কিছুটা সহায়ক হবে।
লেখাটি মনের খবরের মাসিক প্রিন্ট ম্যাগাজিনের বর্ষ ৪, ১০ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০২১ সালে প্রকাশ হয়েছিল। লেখকের অনুমতিতে পুনঃপ্রকাশ হল। এবং লেখার ভাবনা একান্তই লেখকের নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতিমালার সাথে এর কোন বিরোধ নেই।
MK4C-এর সেবা নিতে এখানে ক্লিক করুন
মনের খবর টিভির স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রোগ্রাম দেখতে ক্লিক করুন