মানসিক রোগীদের পাগল বলার দিন ফুরাচ্ছে

দীর্ঘদিন পর আমার এক চিকিৎসক বন্ধুর সাথে দেখা। দেখা হতেই নানা প্রশ্ন আর পাল্টা প্রশ্নে যখন সে শুনল আমি মনোরোগ নিয়ে পড়ছি তখন হঠাৎ বিস্ফোরিত হাসি! তুই পাগলের ডাক্তার হবি; হা-হা-হা…।

আমি মনোরোগের চিকিৎসক হব এটা শুনে যদি একজন চিকিৎসক বন্ধুর প্রতিক্রিয়া এই হয় তবে চিকিৎসা পেশার সাথে যারা জড়িত নয় তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আর যারা রোগী তাদের অবস্থা তো আরও করুণ। পরিবার, সমাজ এবং কর্মক্ষেত্র- সবখানে মুখোমুখি হতে হয় বিরূপ পরিস্থিতির। সহযোগিতার বদলে প্রায়শই ঘটে নিগ্রহ। অথচ এক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজন ছিল সাহায্য ও সহযোগিতার যা তাদের রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করতো। তবে আশার আলো এই যে, ধীরে হলেও এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে । অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে চলছে এর পথ চলা।

সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত অস্বাভাবিক আচরণগুলোর কারণ বলা হত শয়তানের কাজ আর রোগীদের বলা হত ‘অশুভ আত্মা’ বা ‘ডাইনি’। যার ফলে তাদের স্থান হত জেলে অন্যান্য কয়েদিদের সাথে। আঠার শতাব্দীতে এ ধারণার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। তখন মানসিক রোগীদের বলা হত ‘পাগল’ বা ‘উন্মাদ’ এবং তাদের জন্য তৈরি করা হল ‘Mental Asylum’ বা পাগলা গারদ। এসব পাগলা গারদে মানবিক আচরনের বদলে এক রকম শোষণ করা হত। ‘Clifford Beer’s’, ‘Phillippe pinel’ দের ভূমিকা পরবর্তীতে এইসব পাগলা গারদগুলোয় রোগীদের প্রতি মানবিক আচরণ দেখানোর ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করেন। Phillippe pinel সর্বপ্রথম রোগীদের শিকলবদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি দেন।

এইসব মানসিক রোগীদের রোগের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও জানা না গেলেও এটা নিশ্চিত করে বলা যায় এটা কোন শয়তানের কারসাজি নয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৭ সালে প্লেটো বলেছিলেন, মানসিক রোগের কারণ মস্তিষ্ক ঘটিত আর খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৫ সালে এরিস্টটল বলেছিলেন, হৃদয় ঘটিত সমস্যা। ১৮৪৮ সালে ‘Phineas Gaze’এর মস্তিষ্কে লোহার রড ঢুকে গেলে তার মস্তিষ্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তীতে দেখা যায় তার বুদ্ধিমত্তার কোনো সমস্যা না হলেও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে অনেক বেশি। এ থেকে তখন ধারণা পাওয়া যায় যে, মস্তিষ্কের কোনো না কোনো এলাকা ব্যক্তিত্বের সাথে জড়িত আর এই ব্যক্তিত্বের সাথে জড়িত সমস্যা প্রায় সব মানসিক রোগীর ক্ষেত্রেই দেখা যায়। ১৮৮৬ সালে সিগমন ফ্রয়েডের ব্যক্তিত্ব তত্ত্ব পরবর্তীতে অনেক গবেষণার সূত্রপাত করে, জন্ম দেয় নানা বিতর্কের। বিংশ শতাব্দীতে এসে ফ্রয়েড, বি.এফ. স্কিনার ও জে.বি ওয়াটসন মানসিক রোগের ক্ষেত্রে জীবনতাত্ত্বিক ও সামাজিক ভূমিকার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন। গবেষণা এগিয়ে চলেছে; নানাবিধ মতবাদের জন্ম হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখন বলা হচ্ছে কোনো একক কারণ নয় বরং জন্মগত, জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো বিশেষ ঘটনা, সামাজিক ও পারিবারিক প্রভাব এমনকি মস্তিষ্কের নানা রাসায়নিকের হ্রাস-বৃদ্ধি এই রোগের পেছনে একসাথে কাজ করছে। হয়ত সামনে এর সুনির্দিষ্ট কারণও খুজে পাওয়া যাবে।

তবে যাই হোক আমাদের দেশে রোগের কারণ অনুসন্ধাণে গবেষণামূলক কাজ খুব একটা না হলেও কাজ হচ্ছে মানসিক রোগ সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে, সচেতনতা বৃদ্ধিতে ও নিজের অধিকার তৈরিতে। মানসিক স্বাস্থ্য সেবার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা অনেকেই সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছেন। অনেকে চেষ্টা করছেন সরকারি ভূমিকা বৃদ্ধিতে। বিশ্বের প্রথম মানসিক হাসপাতাল ৭০৫ সালে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হলেও আমাদের দেশে এর সূচনা হয় পাবনায়, ১৯৫৭ সালে। তখন এর শয্যা সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০টি যা বর্তমানে ৫শটি। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট এবং অনেক সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় রয়েছে মানসিক রোগ বিভাগ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরিতে চালু রয়েছে বিভিন্ন কোর্স। কাজ চলছে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসকের পদ তৈরীতে। নিয়মিত প্রতি বছর পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। সরকারও এখন উপলদ্ধি করতে পারছে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার প্রয়োজনীয়তা।

আমরা আশান্বিত। হয়ত সেই দিন খুব বেশি দূরে নয় যখন মানসিক রোগীদের কেউ ‘পাগল’ বলে সম্বোধন করবে না। বাড়িয়ে দিবে সহযোগিতার হাত।

ডা. ওয়ালিউল হাসনাত সজীব
ফেজ-বি (রেসিডেন্ট)
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বিএসএমএমইউ


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleসুখী হোন বিবাহিত জীবনে: দাম্পত্য সম্পর্কে সহিংসতা ও শান্তি- পর্ব ৪
Next articleদ্রুত বীর্যপাত ও করণীয়
সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, সিরাজগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here