গর্ভাবস্থায় নারীর নিদ্রাহীনতা

একজন নারীর জীবনে মা হওয়া অত্যন্ত আনন্দের। বড় প্রাপ্তির বিষয়। এটা একটা বিশাল অর্জন। পাশাপাশি একজন নারী থেকে একজন মা হওয়ার এই ক্রান্তিকালে নারীদেরকে অনেক মানসিক চাপ এবং শারীরিক কষ্টও সহ্য করতে হয়। আর তাই অধিকাংশ নারীই (শতকরা প্রায় ৭৮ ভাগ) গর্ভাবস্থায় অল্পবিস্তর ঘুমের সমস্যায় ভুগে থাকেন। আর এদের মাঝে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী তীব্র পর্যায়ের ঘমের সমস্যায় আক্রান্ত হন। গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যা নানাবিধ কারণেই হতে পারে। পেটের বর্ধিত আকারের জন্য অস্বস্তি, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, গলা ও বুক জ্বালাপোড়া করা, কোমড় এবং পা ব্যথা, ঘন ঘন প্রসাব হওয়া, গর্ভের শিশুর নড়াচড়া, বমিভাব ও ভোরে ঘুম ভেঙে যাওয়া, শরীরটাকে ভারী বোধ হওয়া, শিশুর আগমনের ভাবনা, শিশুর প্রতি দায়িত্বপালন ও সঠিক পরিচর্যা কতটুকু করতে পারবে তা নিয়ে আশঙ্কা, হরমোনের পরিবর্তন ইত্যাদি।

কিছু কিছু অনিদ্রারোগ যেমন- রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম এবং স্লিপ এপ্নিয়া গর্ভাবস্থায় খুব বেশি দেখা যায়। এগুলোতে তীব্রমাত্রায় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম-এ শোয়ার পর পায়ের মাংসপেশিতে একধরনের অস্বস্তিকর অনুভুতি হয়। এতে পা নাড়ালে স্বস্তিবোধ হয়। তাই ঘুমের মাঝে রোগী পা ছোড়াছুড়ি করে, আর তাতে ঘমের ব্যাঘাত ঘটে। স্লিপ এপ্নিয়াতে অল্প সময়ের জন্য শ্বাসরোধ হয় এবং ঘুম ভেঙে যায়।

এসময় বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগজনিত রোগেও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। বিষণ্ণতায় মাঝরাতে বারবার ঘুম ভেঙে যায়, ঘুম ভাঙার পর আর ঘুম আসে না, সুস্থ থাকাকালীন সকালের নির্দিষ্ট যে সময়টাতে ঘুম থেকে জাগে তার ২ বা ১ ঘন্টা পূর্বে ঘুম ভাঙে। রোগী ঘুমিয়ে তৃপ্তি পান না। নিজের মাঝে সতেজতা অনুভব করেন না। উদ্বেগজনিত রোগে ঘুম আসতে সমস্যা  হয়। তাই এ রোগগুলো আছে কিনা তা নির্ণয় করা জরুরি। রোগের সঠিক শনাক্তকরণের উপর নির্ভর করে এর উপযুক্ত চিকিৎসাব্যবস্থা। আর তাই এসব ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত রোগের চিকিৎসা করলে ঘুমের সমস্যাও দূর হয়। সাধারণত ফ্লুক্সেটিন, নরট্রিপটাইলিন, এমিট্রিপটাইলিন বিষণ্ণতা রোগের এই ঔষধগুলো এ সময়ে ব্যবহার করা নিরাপদ বলে গণ্য।

গর্ভাবস্থায় ঘুমের ঔষধ ব্যবহার নিরাপদ কিনা বা কতটুকু নিরাপদ তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। পর্বের গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে ঘুমের জন্য বেনজোডায়াজেপাইন নিলে গর্ভস্থ শিশুর ক্লেফ্ট লিপ (কাটা ঠোঁট), ক্লেফ্ট পেলেট (তালতে ফাঁক থাকা) হওয়ার ঝকি বেড়ে যায় ৭% অর্থাৎ প্রতি ১০০০ জনের মাঝে ৭ জনের। কিন্তু সাম্প্রতিককালের কিছু গবেষণায় এ ধরনের কোনো সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। যদিও কিছু কৌশল অবলম্বন করলে বা স্লিপ হাইজিন মেনে চললে ঘুমের গুণগত মান বৃদ্ধি পায় তথাপি কিছুসংখ্যক নারীর কিছু ঔষধ ব্যবহারের একান্ত প্রয়োজন হতে পারে। এক্ষেত্রে লোরাজেপাম, ক্লোনাজেপাম ইত্যাদি কম মাত্রায় ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে প্রথম তিনমাস (০-১২ সপ্তাহ) বা ফার্স্ট ট্রাইমেস্টারে কোনো প্রকার ঘুমের ঔষধ ব্যবহার নিরাপদ নয়। কারণ তাতে টেরাটোজেনেসিস বা মানবভ্রূণটির ক্ষতিসাধন হতে পারে। শিশুটি জন্মগত বৈকল্য নিয়ে জন্ম নিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে গর্ভপাতও হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয় তিনমাস (১৩-২৮ সপ্তাহ) বা সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারে এ গ্রুপের ঔষধ ব্যবহার কিছটা নিরাপদ। আর শেষ তিনমাস (২৯-৪০ সপ্তাহ) বা থার্ড ট্রাইমেস্টারে ঔষধ ব্যবহার করলে নিওন্যাটাল টক্সিসিটি হতে পারে বা নবজাতকের মাঝে উইথড্রয়াল ইফেক্টস বা ঔষধ প্রত্যাহারজনিত লক্ষণ অধিকন্তু বিভিন্ন প্রকার শারীরিক এবং মানসিক রোগের কারণেও গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে রিস্ক-বেনিফিট রেশ্যিউ বিবেচনা করে সেসব রোগের চিকিৎসা করতে হবে। রোগী এবং তার গর্ভস্থ শিশুর জন্য সর্বাধিক নিরাপদ ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করার প্রয়াস থাকতে হবে। এছাড়া স্লিপ হাইজিন মেনে চলা, শারীরিক এবং মানসিক প্রশান্তির জন্য ব্রিদিং রিলাক্সেশন বা শ্বাসের ব্যায়াম, নিয়মিত পুষ্টিকর এবং পর্যাপ্ত খাদ্যগ্রহণ, বিশ্রাম নেয়া, পারিবারিক সহায়তা ও সর্মথন ইত্যাদি এ সমম্যা সমাধানে কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে।

স্লিপ হাইজিন মেনে চলার জন্য কিছু নিয়ম :
প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে জাগা।

বিছানাটি শুধু ঘমের জন্য ব্যবহার করা। বিছানাটি হবে পরিছন্ন ও পরিপাটি। খুব শক্ত নয়, আবার খুব নরমও নয়। পরিধানের পোশাক হতে হবে আরামদায়ক, ঢিলেঢালা।

যদিও আমরা জানি যে, গর্ভাবস্থায় পর্বের চেয়ে দৈনিক ২ ঘন্টা বেশি ঘমানোর প্রয়োজন; বিশেষ করে প্রথম এবং শেষ তিনমাস, কারো কারো ক্ষেত্রে পুরো সময় জুড়ে। যাদের ঘমের সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে দিনের বেলা একাধারে ৩০ মিনিটের অধিক সময় ঘুমানো যাবে না। ঘুমানোর সময় কাত হয়ে শোয়া শ্রেয়, বাম কাত হয়ে শোয়া অধিক কার্যকর।

ঘরের উজ্জ্বল আলো নিভিয়ে দিতে হবে। ঘরটি হতে হবে কোলাহলমুক্ত। কারো কারো ক্ষেত্রে ঘমের আবেশ তৈরি করে এমন কিছু মিউজিক সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

ঘুমাতে যাওয়ার ২ ঘন্টা আগে থেকে ভারী কোনো কাজ, ব্যায়াম, উত্তেজক কোনো নাটক-সিনেমা দেখা যাবে না, উত্তেজক হওয়ার মতো কোনো কাজ করা যাবে না।

প্রতিদিন সকালে বা বিকেলে একটা নির্দিষ্ট সময়ে ২০- ৩০ মিনিট হাঁটা, সাঁতার কাটা, ধীরে ধীরে দৌড়ানো বাঅন্য কোনো ব্যায়াম (যেমন: ইয়োগা, এরোবিকস) করা যা রাতের ঘমের গুণগত মান বৃদ্ধি করে। তবে অবশ্যই তা ঝুঁকিপর্ণ প্রেগন্যান্সিতে করা যাবে না। এক্ষেত্রে গাইনি এবং ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে চলাই উত্তম।

অতিরিক্ত তৈলাক্ত, ঝাল, ভাজাপোড়া খাবার, টকজাতীয় খাবার, বর্ণযুক্ত পানীয় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই রাতে অথবা ‍ঘুমাতে যাওয়ার পর্বে এগুলো বর্জন করা বাঞ্ছনীয়।

ঘুমাতে যাওয়ার ২০ মিনিটের মধ্যে যদি ঘুম না আসে, তাহলে বিছানা পরিত্যাগ করা এবং হালকা কাজ যেমন হাস্যরসপূর্ণ কোনো নাটক দেখা, গল্পের বই পড়া, ম্যাগাজিন পড়া, পায়চারি করা, শরীরে এবং মনে প্রশান্তি আনে এমন ব্যায়াম করা (যেমন: ব্রিদিং রিলাক্সেশন, মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন ইত্যাদি)। ঘুমাতে গিয়ে প্রাত্যহিক জীবনের নেতিবাচক ঘটনা নিয়ে চিন্তা না করা।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleমহামারীতে বাড়ছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা; লাগাম টানুন কিছু সহজ কৌশলে
Next articleআত্মহত্যা থেকে বেঁচে ফেরা মানুষদের মানসিক উন্নতিতে করনীয়
ডা. সাইফুন নাহার সুমি
সহকারি অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here