মানসিক রোগ চিকিৎসায় কার কী ভূমিকা?

0
119

মানসিক রোগ ছড়িয়ে আছে বিশ্বব্যাপী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে, ‘বিশ্বে প্রতি চার জনের মধ্যে এক জন তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এর দ্বারা আক্রান্ত হয়। যদিও অনেক লোক এতে আক্রান্ত হয়, তবু লোকেরা মানসিক রোগকে গোপন করে রাখে, উপেক্ষা করে এবং এটাকে খারাপ চোখে দেখে।
শুরুতে মানসিক রোগকে বিভিন্ন ভূতপ্রেত, অপদেবতার প্রকোপ বা সৃষ্টিকর্তার শাস্তি বলে ভাবা হলেও এই ধ্যানধারণার পরিবর্তন হতে শুরু করে ১৮ শতকের পর থেকে। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে মানসিক রোগ চিকিৎসার আধুনিক ঔষধ আবিষ্কৃত হয়। এরপর সময়ের সাথে সাথে মানসিক রোগ চিকিৎসারও অগ্রগতি সাধিত হয়। আগে মানসিক রোগীকে অ্যাসাইলাম বা পাগলা গারদে শেকলবদ্ধ করে রাখা হলেও এখন বলা হয়, হাসপাতাল থেকে যথাসম্ভব দ্রুত পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে রোগীকে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু দ্রুত তাদেরকে পারিবারিক পরিবেশে ফেরত পাঠানো এত সহজ বিষয় নয়। এর জন্য চাই দলবন্ধ ভূমিকা। যে দলে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা সাইকিয়াট্রিস্ট প্রধান ভূমিকা পালন করেন। সাইকিয়াট্রিস্টের কাজ হচ্ছে রোগীর রোগ নির্ণয় করা ও চিকিৎসা কী হবে তা ঠিক করা। অর্থাৎ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের মূল দায়িত্ব হচ্ছে, মানসিক রোগ নির্ণয় করে প্রয়োজন অনুযায়ী ঔষধসহ, মনোসামাজিক চিকিৎসা ও অন্যান্য পরামর্শ প্রদান
করা। চিকিৎসা হিসেবে ঔষধ বা সাইকোথেরাপি বা উভয়েরই প্রয়োজন হতে পারে। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট উভয় ক্ষেত্রেই পারদর্শী হন। ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা শুধুমাত্র একজন সাইকিয়াট্রিস্টই দিতে পারেন। তবে তিনি প্রয়োজন অনুসারে সাইকোথেরাপির জন্য রোগীকে মনোবিদের (Psychologist) বা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সমস্যা দূরীকরণের মাধ্যমে তার সীমাবদ্ধতাকে গুরুত্ব দিয়ে দৈনন্দিন জীবনে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করে। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো, শারীরিক-মানসিক বা সামাজিকভাবে অক্ষম একজন ব্যক্তিকে দৈনন্দিন কাজে তার সামর্থ্য অনুযায়ী স্বনির্ভর করা। এক্ষেত্রে একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট এসব সমস্যা নিয়ে কাজ করেন, যা তাকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নিয়ে যেতে সাহায্য করে। সাধারণত আমাদের দেশের একজন মানুষের ভালোমন্দ প্রাথমিকভাবে দেখভাল করে থাকে পরিবার। তাই মানসিক রোগ চিকিৎসায় পরিবারের ভূমিকা ভুলে গেলে চলবে না। পরিবারকে রোগীর রোগের লক্ষণ বুঝে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন যেমন হতে হবে তেমনি মানসিক বা আর্থিকসহ সবধরনের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, বেশিরভাগ পরিবারে রয়েছে মানসিক রোগ নিয়ে অজ্ঞতা। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করাতে অনেক পরিবারই আর্থিকভাবে অক্ষম। তাই পরিবারের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকাও জরুরি। কিন্তু সমাজেও রয়েছে মানসিক রোগীদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা। অথচ এই নেতিবাচক ধারণা দূর না হলে তাদেরকে স্বাভাবিক স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনা কঠিন। তাই এইসব নেতিবাচক ধারণা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে মিডিয়া। পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে সবাইকেই। রাষ্ট্রকেও এই রোগের চিকিৎসায় ভূমিকা নিতে হবে যেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকেই রোগের চিকিৎসা শুরু করা যায়। রোগীকে সুচিকিৎসা প্রদান করাসহ পুনর্বাসনের দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকেই যেন রোগী সহজে ঔষধ পেতে পারেন সেটি নিশ্চিত করা ও চিকিৎসকদেরও নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
মানসিক রোগীকে বোঝা না ভেবে সম্পদে রূপান্তর করার দায়িত্ব কিন্তু পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং এর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সবারই। প্রত্যেকেই যদি তার নিজ অবস্থান থেকে যার যা ভূমিকা তা সঠিকভাবে পালন করতে পারে তবেই একসময় তারা আর আমাদের বোঝা হয়ে থাকবে না বরং সমাজ থেকে অন্ধকার দূর করতে এগিয়ে আসতে পারবে।

-ডা. ওয়ালিউল হাসনাত সজীব
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, পাবনা।

লেখাটি মনের খবরের মাসিক প্রিন্ট ম্যাগাজিনের বর্ষ ১, ১১ তম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১৮ সালে প্রকাশ হয়েছিল। লেখকের অনুমতিতে পুনঃপ্রকাশ হল। এবং লেখার ভাবনা একান্তই লেখকের নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতিমালার সাথে এর কোন বিরোধ নেই। 

MK4C-এর সেবা নিতে এখানে ক্লিক করুন

মনের খবর টিভির স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রোগ্রাম দেখতে ক্লিক করুন

Previous articleপ্যালিয়েটিভ কেয়ার নিয়ে মনের খবর টিভির বিশেষ আয়োজন ১৪ই অক্টোবর
Next articleআত্মহত্যা প্রতিরোধই প্রধান চিকিৎসা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here