মাইন্ডফুলনেস হলো একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া, যাতে ইচ্ছাকৃতভাবে বর্তমানে ঘটে যাওয়া বিষয়াবলীর উপর মনোনিবেশ করা করা হয়। মাইন্ডফুলনেস অনুশীলনের ফলে অতিরিক্ত মানসিক চাপ, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা, উত্তেজনা এবং যেকোনো আসক্তি বা নেশা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ধ্যান এবং অন্যান্য অনুশীলনের মাধ্যমে এটি আয়ত্ত করা সম্ভব। এটি বৌদ্ধ ও তিব্বতি মেডিটেশনের ধারা থেকে উদ্ভূত।
মাইন্ডফুলনেসের মূল কথা হলো অতীত ও ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন দুশ্চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত করে বর্তমানের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করা। আরও সহজভাবে বলতে গেলে বর্তমানকে ঘিরে বেঁচে থাকা।
আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন যে বর্তমানকে ঘিরে বেঁচে থাকার অর্থ কী? হ্যাঁ, অতি সাধারণভাবে দেখতে গেলে আমরা বর্তমানেই বেঁচে আছি, আবার একটু গভীরভাবে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে যে, আমরা সেই অর্থে বর্তমানের সঙ্গে সংযুক্ত নেই।
কারণ, বেশির ভাগ সময় আমরা আমাদের মনের রাজ্যে বসবাস করি। আমরা দিনের পর দিন একটি স্বপ্নের মতো রাজ্যে উপস্থিত থাকি। যেখানে আমরা আমাদের চারপাশের বাস্তব জগত থেকে বিচ্ছিন্ন, আমাদের নিজের দেহ বা সত্ত্বা থেকে অনেক দূরে।
আমরা অতীতের স্মৃতি সমূহে নিমগ্ন, ভবিষ্যতের বিষয়ে গভীর চিন্তা আর উদ্বেগে ডুবে আছি, যা কিছু দেখছি নিরবিচ্ছিন্নভাবে তার বিচার বিশ্লেষণ করে চলেছি।
আক্ষরিক অর্থে আমরা আমাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় এভাবেই হারিয়ে ফেলি। যা আমাদেরকে হতাশা, শূন্যতা এবং গভীর অস্থিরতার সাগরে নিমজ্জিত করে। তবে আশার কথা হলো আপনিও আপনার দৈনন্দিন জীবনে মাইন্ডফুলনেস অনুশীলনের মধ্য দিয়ে জীবনকে বদলে দিতে পারেন।
আসুন অতি সহজে মান্ডফুলনেস আয়ত্ত করার ১০টি উপায় জেনে নিই-
খাওয়ার সময় মনোনিবেশ করুন
বেশির ভাগ সময় খেতে খেতে আমরা মোবাইল, টেলিভিশন, কম্পিউটার বা কথোপকথন চালিয়ে যাই অথবা গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকি। এর মধ্য দিয়ে আমরা খাবারের স্বাদ এবং গন্ধ অনেকটাই এড়িয়ে যাই। ফলে সন্তুষ্টি লাভ এবং পরিপূর্ণ বোধ হবার সম্ভাবনাও কমে যায়।
মনে রাখতে হবে “খাওয়ার সময় খাওয়া, পানের সময় পান”। অন্য কথায়, আপনি যখন খাবার খাচ্ছেন বা কিছু পান করছেন তখন একই সঙ্গে দশটি কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। খাবার বা পানীয়টি শতভাগ উপভোগ করুন, বর্তমানের সঙ্গে সংযুক্ত থাকুন।
হাঁটার সময় মনোনিবেশ করুন
আপনি যখন হাঁটেন তখন মাঝে মাঝে আপনার শরীর এবং আপনার চারপাশের দিকে মনোযোগ দিন। চিন্তা জগতে ডুবে না থেকে কিভাবে আপনার পা মাটি স্পর্শ করছে এবং মাটি থেকে উঠে আসছে তা অনুভব করুন।
আপনার চারপাশে কী চলছে তা অনুভব করুন- দর্শনীয় স্থান, শব্দ এবং উদ্ভাসিত জীবন প্রবাহ লক্ষ্য করুন। হয়ত একটি নতুন পৃথিবীর সন্ধান পেয়ে যাবেন, যা এর আগেও লক্ষ্য করেন নি।
শ্বাস-প্রশ্বাস নিরীক্ষণ করুন
মাঝে মধ্যেই নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ স্থাপন করুন। আপনি যখন শ্বাস-প্রশ্বাসে মনোযোগ দেবেন, তখন এটি আপনাকে আপনার মন থেকে শরীরের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। আপনি চিন্তা, উদ্বেগ ও ভয় থেকে ক্ষণিকের জন্য নিজেকে মুক্ত বোধ করবেন। আপনি আপনার আপন আধ্যাত্মিক সত্তার দিকে ফিরে আসবেন।
আপনার ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করুন
আপনার সংবেদন সমূহ- স্পর্শ, গন্ধ, স্বাদ, শব্দ ও দৃষ্টি বর্তমান মুহূর্তে আপনার প্রবেশদ্বার। কিন্তু যখন আপনি চিন্তায় হারিয়ে যান, তখন আপনার অনুভূতিগুলো আপনি সম্পূর্ণরূপে অনুভব করতে পারবেন না। তাই চিন্তায় ডুব দেবার বিপরীতে যা স্পর্শ করছেন, যে গন্ধ নাকে লাগছে, যে শব্দ কানে আসছে এবং যা দেখতে পারছেন সেসব সৌন্দর্য উপভোগ করুন।
কাজের মধ্যে বিরতি নিন
ফোনের উত্তর দেয়ার আগে একটু থামুন এবং রিংটোনটি শুনুন। ফোনটি হাতে নিলে এর ওজন অনুভব করুন। এছাড়া দরজা খোলার সময় হাতলটি অনুভব করুন। এভাবে সব কাজ শুরু করার আগে একটু থেমে নিজেকে অনুভব করুন, কাজটি অনুভব করুন।
অন্যের কথা মন দিয়ে শুনুন
আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ লোক যখন কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন তখন তা মন দিয়ে শোনেন না, বরং তা বিচার বিশ্লেষণ করতে শুরু করে দেয় বা অন্য কোনো চিন্তায় ডুবে থাকেন। আপনার চিন্তায় ভ্রষ্ট না হয়ে অপর ব্যক্তিটি আপনাকে কী বলছে তা পুরোপুরি মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করুন। মন দিয়ে অন্যের কথা শুনলে আপনার যখন কথা বলার পালা আসবে তখন আপনি সুন্দরভাবে উত্তর দিতে পারবেন। উত্তর নিয়ে আলাদা করে ভেবে সময় নষ্ট করতে হবে না।
পছন্দের কাজে আত্মনিয়োগ করুন
আমাদের সবার পছন্দের কিছু নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে, যা আমরা করতে পছন্দ করি। এগুলি আমাদেরকে আমাদের সত্তার সঙ্গে সংযুক্ত করে এবং পুরোপুরি জীবন্ত করে তোলে। এটি হতে পারে রান্না, নাচ, গান, বাগান করা, লেখালেখি করা, চিত্রকলা, হাঁটতে যাওয়া, সাঁতার করা বা আসবাব তৈরি করা।
আমরা এই জিনিসগুলি করতে এত পছন্দ করি যে, আমরা প্রায়শই সেগুলিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। আমরা আমাদের ক্ষুদ্রতর সত্তা থেকে বৃহৎ সত্তার দিকে ধাবিত হই, অর্থাৎ চিন্তাভাবনা ও উদ্বেগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বর্তমানে নিমগ্ন হই।
ধ্যান অনুশীলন করা
ধ্যানের অনেক উপকারিতা রয়েছে। এটি আমাদের দেহ ও মনকে সতেজ রাখতে সহায়তা করে। আমাদের শক্তি, সুখ, অনুপ্রেরণা এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি বাড়িয়ে তোলে। তাই নিয়মিত ধ্যান বা মেডিটেশন অনুশীলন করুন।
ভ্রমণ করুন
নতুন দর্শনীয় স্থান, শব্দ ও গন্ধ আমাদের মনকে আন্দোলিত করে। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি বর্তমানকে উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে এবং আমাদেরকে মনস্তাত্ত্বিক জগতের জটিলতা থেকে মুক্তি দেয়। তাই হাতে সময় থাকলে ভ্রমণের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
নতুন কোথাও বেড়াতে না গেলে অন্তত একটি ভিন্ন পথে বাজারে বা অফিসে যাবার চেষ্টা করুন। একটি নতুন কফিশপে গিয়ে থামুন, স্থানীয় কোনো নতুন জায়গায় যান বা কোনো নতুন রেসিপি রান্না করুন।
আপনার চিন্তাভাবনা পর্যবেক্ষণ করুন
আপনি আপনার চিন্তার কাছে জিম্মি নন, আপনি আপনার চিন্তা সমূহের পর্যবেক্ষক। আপনি উচ্চতর সত্তা এবং আপনার চিন্তা-ভাবনার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বাধীন।
নিরপেক্ষভাবে চিন্তাগুলিকে পর্যবেক্ষণ করুন। চিন্তায় জড়িয়ে পড়বেন না বা অতীতের স্মৃতিতে ডুবে যাবেন না। চিন্তাগুলিকে ভেসে থাকা মেঘের মতো আসতে এবং যেতে দিন। আপনি শুধু পর্যবেক্ষণ করুন। লম্বা শ্বাস নিন, নিজের সত্তাকে অনুভব করুন।
তথ্যসূত্র: হাফপোস্ট.কম