বৈষম্যপূর্ণ বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য অচিকিৎসায় বা অপচিকিৎসায় গরীবদের মানসিক রোগ

0
53

সব ধরনের উদ্দীপনাতেই আমাদের মন, স্নায়ুতন্ত্র কমে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। ব্যতিক্রম ব্যথার উদ্দীপনা। আর যার ব্যথা সে-ই বুঝে। ‘কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে’। বৈষম্য এমনি এক মনো-সামাজিক উদ্দীপনা, বৈষম্যপীড়িত জনই যা হাড়ে হাড়ে টের পান। বৈষম্য বহুবিধ : ধনবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, ধর্মবৈষম্য, বর্ণবৈষম্য, জাতিবৈষম্য, ইত্যাদি। আমাদের দেশে ধনবৈষম্য ও লিঙ্গবৈষম্য সর্বত্র ব্যাপ্ত। আমি সব বৈষম্যের সেরা বৈষম্য ধনবৈষম্য নিয়েই বাগবিস্তার করব। সামগ্রিকভাবে বিশ্বের ধনবৃদ্ধি ঘটে চলেছে। কিন্তু তা ঘটছে ধনী ও নির্ধনের ধনবৈষম্য বাড়িয়ে বাড়িয়ে। এই শুভংকরের ফাঁকিটি বড়ো নির্লজ্জভাবে উদাম করে দিচ্ছে করোনা মহামারি। গরীব দেশের কথা বাদ দিয়ে ধনী দেশের কথাই বিবেচনা করা যাক। সেখানেও দেখি আক্রান্তের হার, মৃত্যুর হার দুই দিকেই বৈষম্যপীড়িত জনতা সুবিধাভোগীদের অনেক ছাড়িয়ে গেছে। (দেখুন : Inequality Deadly Toll, Nature volume ৫৯২, ২৯ October ২০২১) বৈষম্যটি টিকা পাওয়ার বেলাতেও কার্যকর। ধনী দেশগুলো যেখানে বুস্টার ডোজ দেয়া শুরু করেছে, সেখানে গরীব দেশগুলোর মানুষ প্রথম ডোজই পাচ্ছেন না। মানসিক স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে জড়িতদের মনটি সংবেদনশীল। তাই তারা এবার বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য করেছেন, ‘বৈষম্যপূর্ণ বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’।

মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ধনবৈষম্যের প্রভাব

যদি আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ধনবৈষম্যের প্রভাব বিবেচনা করি, তাহলে দেখব মানুষকে রোগপ্রবণ হিসাবে গড়ে তোলা, রোগের প্রকাশ ঘটানো, এবং রোগকে জিইয়ে রাখা; সব পর্যায়েই ধনবৈষম্য কাজ করে চলে। শুরুতে আসা যাক মানুষকে মানসিক রোগপ্রবণ হিসাবে গড়ে তুলতে ধনবৈষম্যের প্রভাব নিয়ে। গরীব অন্তঃসত্ত্বা অপুষ্টিতে ভোগে, গর্ভের সন্তানও তার দায় বহন করে। প্রসবকালীন সেবাও তাদের ভাগ্যে জোটে না, প্রসবকালীন জটিলতার ফলাফল সন্তানে বর্তায়। শিশুর বেড়ে উঠার সময় অপুষ্টি, বিভিন্ন রোগ, তুলনামূলকভাবে নিঃস্ব সামাজিকসাংস্কৃতিক পরিবেশ, তার শারীরিক মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে শিশুটিকে মানসিক রোগপ্রবণ হিসাবেই গড়ে তোলে।

এসব শিশুর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সীমিত। তাদের শৈশব-কৈশোরের দ্রুতই অবসান ঘটে। তারা অপরিণত অবস্থাতেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। মেয়েদের বাল্য-বিবাহের ঘটনা ঘটে গরীব পরিবারগুলোতেই। তাদের জীবিকা অনিশ্চিত। কর্মের পরিবেশ স্বাস্থ্যের অনুকূল নয়। কাজের চাপ বেশি। দরিদ্ররা শুধুমাত্র পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য এবং স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান থেকেই বঞ্চিত হয় না।

তাদের বাসস্থানের পরিবেশ এবং কাজের দীর্ঘ সময়-এ দুয়ে মিলে তাদেরকে পরিপূর্ণ ঘুমের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করে। এসব কিছুই মনো-সামাজিক চাপ হিসাবে কাজ করে রোগপ্রবণদের মধ্যে মানসিক রোগের প্রকাশ ঘটায়।

গরীবদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার সীমিত। মানসিক রোগ সম্বন্ধেও তাদের ধারণা নাই, কিংবা থাকলেও তা ভ্রান্ত। এই অজ্ঞতার কারণে কিংবা আর্থিক অসামর্থের জন্য তারা মানসিক রোগের চিকিৎসা করায় না। কিংবা মানসিক রোগকে উপরি পাওয়া, জ্বিনে ধরা ইত্যাদি ভেবে ওঝা কবিরাজের শরণাপন্ন হয়। অন্যদিকে মানসিক রোগের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থাও তাদের নাগালের বাইরে। তাই গরীবদের মানসিক রোগ অচিকিৎসায় বা অপ-চিকিৎসায় দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়। করণীয় কী?

ধনবৈষম্যই বলি কিংবা লিঙ্গবৈষম্যই বলি, সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ম। আমরা পেশাজীবীগণ সমাজ ও রাষ্ট্রের অংশ হিসাবে তাতে অংশ নিতে পারি। এবারের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে ‘বৈষম্যপূর্ণ বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’ প্রতিপাদ্য হিসাবে গ্রহণ করার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীগণ বৈষম্যের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছেন। সামাজিক পরিবেশের ইতিবাচক পরিবর্তন না করে শুধুমাত্র রোগ চিকিৎসার মাধ্যমে কোনো সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবু মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে যে বৈষম্যসমূহ বিরাজমান, যদি আমরা সেসবকে চিহ্নিত করে দূরীকরণে উদ্যোগী হই, তাতে বৈষম্যের শিকারদের যন্ত্রণা লাঘবে কিছুটা সহায়ক হবে।

 

অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার

মানসিক স্বাস্থ্য, মাদকাসক্তি এবং যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।

সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৯ম সংখ্যায় প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে 

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous articleঅভিভাবকগণ প্রতিদিন বাসায় বসে রাজার মতো মাদক গ্রহণ করে
Next articleপ্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ও একটি প্রশ্ন!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here