বিশ্বায়ন বা ভুবনায়ন এমন একটি আন্তর্জাতিক অবস্থা যেখানে পৃথিবীর বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা দেশীয় গন্ডি ছড়িয়ে আন্তঃদেশীয় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র বিশ্ব এখন একটি প্ল্যাটফর্ম এবং এর মূল সহায়ক শক্তি হলো তথ্য প্রযুক্তি। এটি যে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে সাহায্য করছে তা নয়, আর্থ সামাজিক কাঠামোকেও করছে প্রভাবিত। খুব বেশি নয়, ৫০ বছর পিছনে ফিরে দেখলেই দেখা যায় যে, তখন দেশে দেশে মানুষের মাঝে যোগাযোগ মাধ্যম ছিল খুব সীমিত। ব্যয়বহুল বা সময়সাপেক্ষ ভ্রমণের জন্য আন্তঃদেশীয় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল টেলিযোগাযোগ। আজ যেমন নিমিষেই দূরদূরান্তে থাকলেও একজন আরেক জনের সাথে ফেসবুক, টুইটার, ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে যুক্ত তখন তা ছিল অকল্পনীয়। ছোটোবেলার কল্পনাকে হার মানিয়ে শুধুমাত্র একটি আঙুলের চাপে ভিডিও কলে যুক্ত হয়ে পড়ছে ভিন্ন ভিন্ন মেরুর মানুষ।
রাজনৈতিক মতাদর্শের বিনিময়, ব্যবসার প্রসার, শিক্ষা ও জ্ঞানের বিস্তার থেকে শুরু করে সামাজিকতা, ভাবের আদান প্রদানেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এ পরিবর্তন অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু এর একটি নেতিবাচক প্রভাবও চলে এসেছে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর।
মানসিক স্বাস্থ্য কী? এটি হলো সুস্থতার এমন একটি অবস্থা যেখানে একজন মানুষ তার সক্ষমতা বুঝতে পারে, যাপিত জীবনের চাপকে সামলাতে পারে, উৎপাদনমুখী ও ফলপ্রসূ কাজ করতে পারে এবং তার সম্প্রদায়ের মাঝে কার্যকরী অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
মানসিক অসুস্থতা কি আসলেই বাড়ছে এ যুগে? ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, প্রতি ১০ জনে ১ জন মানসিকভাবে অসুস্থ (১০.৭%)। ফিরে তাকাই বাংলাদেশের তথ্য-উপাত্তে। ২০১৯ সালে দেশব্যপী এক গবেষণায় দেখা গেছে যে কমপক্ষে ১৬.৮% মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তবে কি বিশ্বায়নের প্রভাবে বাড়ছে মানসিক টানাপোড়ন? একটি একটি করে দেখলে দেখা যায় নিচের অবস্থাগুলির প্রকোপ-
একাকিত্ব : হাতের মুঠোয় ফোনের মাঝে বিশ্ব, কিন্তু পাশের মানুষটির সাথে মন খুলে কথা বলা হয় না। সামাজিকতা বিমুখ হয়ে আমরা হয়ে পড়ছি ভার্চুয়াল জগতের দাস। ফলাফল নিদারুণ একাকিত্ব। এর হাত ধরেই আসছে হতাশা, বিষণ্ণতা, পারিবারিক ভাঙন এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা।
দ্রুত ধাবমান অর্থনৈতিক চাহিদা, কঠিন যাত্রায় প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিচ্ছে আকাঙ্ক্ষা, উদ্বেগ, মানসিক চাপজনিত রোগাক্রান্ত হয়ে ছিটকে পড়ছে অনেকে জীবন চলার পথ থেকে। এর হাত ধরেই আসছে মাদকাসক্তির মত ভয়াবহ পরিণতি। বিশ্বায়নের সুযোগেই মাদক পাচার এবং প্রাপ্তিও সহজলভ্য হয়েছে।
বিশ্বায়নের আরেকটি ক্ষতিকর দিক হলো আমরা ক্রমশই Organic বা জৈব খাদ্য বিমুখ হয়ে হাতে তুলে নিয়েছি অজৈব খাদ্য সামগ্রী, ফাস্টফুড, বোতলজাত, টিনজাত, খাদ্য পানীয় হয়ে উঠছে আমাদের প্রথম পছন্দ। এর প্রভাবে ঘটছে জেনেটিক পরিবর্তন (Genetic mutation) অতিমাত্রায় অটিজম, অতিচঞ্চলতা, মানসিক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। এছাড়া ক্রমাগত বিদ্যুৎশক্তি, ক্ষতিকারক রশ্মির নিঃসরণও এর পিছনে দায়ী হতে পারে।
পারস্পরিক সংবেদনশীলতা হ্রাস পাওয়া, নিউক্লিয়ার পরিবার এসবও কিন্তু বিশ্বায়নের পরোক্ষ ফল। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ভেদাভেদ ভেঙে সকলেই এখন তথাকথিত আধুনিকতার শিকার। পারিবারিক সহযোগিতার পরিমাণ ও কাছের মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মানুষ এখন কষ্টের সময়গুলি পাড়ি দিচ্ছে একাকী। বয়সকালীন রোগ যেমন ডিমেনশিয়া বা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত প্রাচীন জনগোষ্ঠীর পিছনে এটিই একটি কারণ হিসেবে কাজ করছে না কি? আর এত কিছু যদি নাও মিলাতে পারি, একটি উদাহরণ কিন্তু এখন মারাত্মক প্রকট আর তা হলো: কোভিড-১৯। করোনা ভাইরাসের এই ভয়াবহ বিস্তারও কি বিশ্বায়নের সরাসরি কুফল নয়? প্রতি শতকেই মহামারি হয়েছে কিন্তু তার পরিধির এত ব্যপ্তি হয়নি। এর কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভ্রমণ; এসবই ছিল স্বল্প আকারে।
বর্তমান যুগে চীনের উহান শহরের ভাইরাসটি বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়তে সময় লেগেছে মাত্র কয়েক মাস। তার পরের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। কোভিড আক্রান্ত একজন ব্যক্তি যেমন পরবর্তী নানাবিধ মানসিক সমস্যার শিকার হচ্ছে, সেইসাথে আর্থসামাজিক জীবনকেও কোভিড করেছে বিপর্যস্ত।
এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, কোভিড-১৯ মহামারির সময় বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীতে বিষণ্ণতার বিস্তার (৫৭.৯০%), মানসিক চাপ (৫৯.৭০%), উদ্বেগ (৩৩.৭০%)। এই উপসর্গগুলো মহামারি পূর্ব হারের তুলনায় অনেক বেশি। কাজেই খুব ছোটো পরিসরে বিশ্বায়ন যে মানসিক স্বাস্থ্যের অপকার করছে তা দৃশ্যমান। কীভাবে এর প্রতিকার সম্ভব? চলুন জেনে নেই-
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার কমাই
ভার্চুয়াল জগৎ ছেড়ে বাস্তব জীবনে আরো বেশি সময় ও মেধা ব্যয় করি
মাদককে রুখে দাঁড়াই
বিশ্ব খোলা হলেও নিজ সংস্কৃতিকে অগ্রসর করি।
চাহিদার ঘোড়ার ঘাড়ে রাশ পরিয়ে মানসিক চাপ তথা উদ্বেগ উত্তেজনা কমাই
মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই
বিশ্বায়নের অবারিত দ্বারে না আসুক আর কুসংস্কার, অপচিকিৎসা। সময়মতো মানসিক রোগের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা গ্রহণ করি।
বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সকল আধুনিক সুযোগ সুবিধাকে মন ও মননের যত্নে নিয়োজিত করি। মানসিক স্বাস্থ্য হয়ে উঠুক প্রধান অগ্রাধিকার।
ডা. জেসমিন আক্তার
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৯ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে