ঢাকা: বিজ্ঞাপনের প্রথম এবং প্রধান কাজ পণ্য বা সেবার প্রচার। প্রচারই প্রসার, বিশ্বায়নের অনুসঙ্গ হিসেবে আমাদের বিবেকে জায়গা করে নিয়েছে। এই দখল সুদীর্ঘ পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে শত বছর পার করেছে। আর এই পরিকল্পনার ফাঁদ সেদিনের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আজকের নির্মলেন্দুগুনকেও মুক্তি দেয়নি। পাশ্চাত্বে এর ব্যাপকতা ভিন্ন মাত্রার।
উন্নয়নশীল অথবা মধ্যম আয়ের দেশ হতে আকাঙ্ক্ষীদের, সূচক নির্ণয়ে ক্রয় ক্ষমতা এবং ক্রয় করার বাসনা অন্যতম। আর ক্রয়কে উস্কে দিতে পণ্য কারবারিরা নানান আয়োজন করেছে। এই আয়োজনে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাইকে আকর্ষণ করার কৌশল রপ্ত করার শিক্ষা, গবেষণা আর মানুষের মনুষ্যত্বের গভীর আকাঙ্ক্ষাকে উসকে দেবার নিয়ত পর্যবেক্ষণ চলছে। মেয়ে শিশুটির বোল ফুটবার আগে তার ঠোঁটে চাই বড়দের মত লিপিস্টক, পাতলা নখে চাই পলিশ। ছেলেটি দুধ খাবে না, টেন্ডুলকার-শাকিব আল হাসানের হাতে বিকল্প শক্তিদায়ক গোলানো আবর্জনা খাবে। মা-বাবাও প্রতি সকালে ঘুমন্ত শিশুটিকে গজ ফিতা দিয়ে মেপে বৃদ্ধি দেখবে আর তৃপ্তির ঢেকুর তুলে পরবর্তী টেন্ডুলকার অথবা ভবিষ্যৎ কারিনার গর্বিত পিতা মাতা দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হবে।
আর এই ভবিষ্যৎ কারিনার জন্য সবচেয়ে বেশী আয়োজন। ইতিহাসে নারী যুদ্ধ-বিগ্রহ-দেশান্তর ইত্যাদি নানান দুর্বিপাকে, যতটা অপমানিত হয়েছে তার চেয়ে তাকে ব্যবহার করে বিকিকিনির যে আয়োজন তা কোনো অংশেই কম ভীতিকারক না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত তার শরীরের সব অংগ প্রত্যঙ্গ অযাচিত প্রদর্শন করে পণ্যের গুণগত মানের সাথে মিলিয়ে আদতে তাকেই পণ্য বানানো হয়। মাঝখান থেকে পুরুষত্ব যেমন বজায় খাকে তেমনি পুরুষের আমৃত্যু যৌন বাসনা চরিতার্থ হয়। ডিওডরেন্ট টাইপের যত বিজ্ঞাপন আমরা দেখি তার ভেতর এমন একটি ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে যেনো একটু মেখে নিলে সহজেই আজ সন্ধ্যায় পুরুষের একজন নারী জুটে যাবে এবং সাক্ষাৎক্ষণেই-‘ডেইট’।
এইসব প্রচার প্রকারন্তরে যদি সামাজিক বিশঙ্খলার জন্ম দেয়, উঠতি তরুণ-তরুণীকে যদি বিপথগামী করে তবে আদালতে যাবার কেনো যুতসই যুক্তিও থাকবে না। যুক্তি যদি কিঞ্চিত থেকেও থাকে এর বিরুদ্ধে মাঠে নামা মানে রাসবত কর্পোরেটের মুখের সামনে নিজের মস্তক এগিয়ে দেয়া।
প্রচার কৌশল-অর্থ উপার্জনের তাগিদে বর্ণবাদকে উসকে দেয়-সাম্প্রদায়িকতাকে জাগিয়ে তোলে। কালো মেয়েটিকে কত দ্রুত ফর্সা বানানো যায় তার জন্য বিস্তর পণ্য নামে নানান নামে। যেন ফর্সা বা সাদাই সর্বোচ্চ মান। এর বিপরীতে কালোকে সুন্দরের প্রতীক করতে যে বিজ্ঞাপন বানানো হয় সেখানেও যিনি কালো মেয়ের মডেল হন তার দৃশ্যমান সব অংশেই সাদা মেকআপের পলেস্তারে ঢাকা। কত যে বোকা বানানোর কৌশল!
সেলফোন যখন পৃথিবীর মানুষের হাতে এল তখন একে প্রযুক্তির যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে আমরা আনন্দিত হলাম। সেই সেলফোন দিনে দিনে কত পাল্টে গেল- এত দ্রুত যে আজকে কেনা সেলফোনটি পরশু কেমন ব্যাকডেটেড হয়ে গেল। আর এখন তো এসেছে স্মার্ট ফোন। কে যেন কবে ভিরের ভেতর হালকা আড্ডায় বলেছিল ‘এখন মানুষ আর স্মার্ট নাই, স্মার্ট হয়ে গেছে সেলফোন’। কে মাথায় এমন উদ্ভট আইডিয়া ঢুকিয়ে দিলো? প্রেমিক-প্রেমিকা মুখের দিকে আর হা করে তাকিয়ে থাকবে না। পরস্পর চোখের ভাষা বোঝার অপলক চেষ্টা করবে না। বগলের ডিয়োডরেন্ট, ঠোটের রং, নোখের রং থেকে শুরু করে গার্মেন্ট আন্ডার-এর ব্র্যান্ড খুঁজবে, আর সব ফুরিয়ে গেলে পরস্পর দুটি স্মার্ট ফোন হাতে নিয়ে দুই দিকে মুখ করে চ্যাট করবে অথবা একটি স্ট্যাটাস লিখবে- ‘ভাল্লাগেনা, ও এত্তো আনস্মার্ট!! মনে হয় সব বেঁচে দেই।’
একটু ফ্রেশ হতে বাথরুম যাওয়া যাক-আহা কত কিছুই না পরে আছে। কেনার জন্য কেনা হয়েছিলো অথবা ব্যবহার তারিখ শেষ হয়ে গেছে তবু মোড়ক খুলা হয়নি।
মুখে এক আজলা স্বছ পানির ঝাপটা।…আহা কি আনন্দ, এই বুঝি ক্লান্তি মুছে দিলো সব।
লেখক
আজাদ আবুল কালাম
বিশিষ্ট নাট্যজন