পিটিএসডি নিয়ে আমাদের মাঝে বেশ কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে – কিভাবে এই সমস্যাটি শুরু হয় এবং এর অর্থ কি, দুটো বিষয়েই। দুর্ভাগ্যবশত, এই ভুল ধারণাগুলোর কারনেই এই সমস্যায় আক্রান্ত মানুষদের সাহায্য করা কঠিন হয়ে পরে। পিটিএসডি সম্পর্কে এই ৮টি তথ্য জানুন যা আপনাকে এই সমস্যা সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত করবে।
পৃথিবীর সব মানুষই তাদের জীবনের কোন না কোন সময়ে মাত্রাধিক ভয়, আতংক বা শঙ্কার মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু যারা পিটিএসডি সমস্যায় আক্রান্ত, তাদের জীবনে এই ভয় তাদের অন্য সব অনুভূতি গ্রাস করে নেয়, এবং তাদের সম্পূর্ণ জীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। তাদের জন্য এটি একটি সর্বগ্রাসী সমস্যা যা তাদের একটি সুস্থ্য ও সুন্দর জীবনের পথে বাঁধা হয়ে দাড়ায়।
পিটিএসডি সমস্যায় আক্রান্ত মানুষ তাদের নিজের জীবন ও প্রিয়জনদের কাছ থেকে দূরে চলে যায়। তাছাড়া, এই মানসিক সমস্যাটি নিয়ে আমাদের সমাজে বেশ কিছু ভুল ধারনা প্রচলিত আছে যার কারনে আমরা আসলে ঠিক জানি না পিটিএসডি একজন মানুষের উপর আসলে কি প্রভাব ফেলতে পারে। ‘দ্যা কেবিন ঢাকা’তে আমরা আমাদের সর্বচ্চ চেষ্টা করি আমাদের কাছে সাহায্যের জন্য আসা একজন রোগীর মানসিক স্বাস্থ্য ফিরিয়ে দিতে। এই লক্ষ্যে একটি ভালো উপায় আমাদের ক্লায়েন্টদের সাথে আসা তাদের প্রিয়জনদের পিটিএসডি সম্পর্কে অবগত করা, এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণকে এই সমস্যা – এবং এর চিকিৎসা – সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানানো।
পিটিএসডি সমস্যায় ভুগছে এমন মানুষের সম্পর্কে এই ৮টি বিষয় জানা আপনার জন্য অত্যান্ত জরুরীঃ
১। শুধুমাত্র যুদ্ধই “পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার” ডেকে আনে না
যদি আপনার কাছের কোন মানুষ পিটিএসডি সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকে তবে এই তথ্যটি জানা আপনার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। পিটিএসডি-র যেসব ঘটনা মিডিয়া আমাদের সামনে উপস্থাপন করে থাকে তার প্রায় সবগুলোই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসা সৈন্যদের নিয়ে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, পিটিএসডি কেবলমাত্র সৈনিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে যে কোন মানুষ যারা কোন প্রকার দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে – যেমন গুরুতর কোন আঘাত, হিংস্রতা, যৌন হামলা বা মৃত্যুর হুমকি, ইত্যাদি – পিটিএসডি সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। বাস্তবিকই, মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে একটি জরিপে দেখা গিয়েছে যে, শতকরা ৪ জন কিশোর এবং ৬ জন কিশোরীর মধ্যে পিটিএসডি’র লক্ষণ দেখা যায়।
২। পিটিএসডি শুধুমাত্র আপনার কল্পনায় নয়
পিটিএসডি, কিছুটা হলেও, একটি মানসিক অবস্থা। কিন্তু এর বেশ কিছু সুস্পষ্ট শারীরিক উপসর্গ রয়েছে। যেসব রোগীরা এই সমস্যায় ভুগছে তারা অতি গুরুতর কিছু শারীরিক উপসর্গ লক্ষ্য করে থাকে। পিটিএসডি’র যেসব শারীরিক উপসর্গ নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা করা হয়েছে সেগুলো প্রায় সবই হৃদযন্ত্র সম্পর্কিত, এবং সেগুলো বেশিরভাগই যুদ্ধ থেকে ফেরা সৈনিকদের নিয়ে করা। কিন্তু এই পরীক্ষাগুলো কেবলমাত্র শুরু হয়েছে। অল্পবয়সী অসামরিক বেশ কিছু পুরুষ ও মহিলার উপর পনঅন্য একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, দমকল বাহিনীতে কাজ করে এমন কিছু পুরুষকর্মী, যারা পিটিএসডি’তে আক্রান্ত, তাদের হাড় ও মাংসে বেশ কিছু সমস্যা দেখা গিয়েছে।
আসল কথা এই যে, ইদানিং অনেক গবেষণায় পিটিএসডি ও বেশ কিছু শারীরিক অসুখের মধ্যে সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে। যেসব পিটিএসডি’তে আক্রান্ত রোগী আমরা আশেপাশে দেখতে পাই তাদের মধ্যে অনেকেই অনেক লুকোনো শারীরিক উপসর্গে ভুগছে। কাজেই যারা এইসব রোগীর আত্মীয়স্বজন ও আপনজন, তাদের উচিৎ রোগীর প্রতি আরও মনোযোগী ও সহানুভূতিশীল হওয়া, এবং তাদের অবস্থার গুরুত্ব ভালো ভাবে উপলব্ধি করা।
পিটিএসডি সমস্যায় আক্রান্ত রোগীরা যে ভয়ভীতি, আতংক ও দুঃস্বপ্ন নিয়ে বাস করে তার মূল উৎস তাদের বর্তমান বাস্তবতা নয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাদের অনুভূতিগুলো প্রচন্ড যন্ত্রণাদায়ক নয়। বার বার দুঃস্বপ্ন দেখে, অতীতের কথা মনে করে এবং অতীতের তীক্ষ্ণ সৃতির কথা চিন্তা করে প্রতিদিন বেঁচে থাকা মানেই বর্তমানে কষ্ট পাওয়া। এসব রোগীর এমনই মনে হয় যে তাদের সব বাজে অভিজ্ঞতাগুলো তাদের বর্তমানেই ঘটছে।
পিটিএসডি সমস্যায় আক্রান্ত রোগীরা সারাক্ষণই খুব অসদাচরণ করতে পছন্দ করে। তাদের কাছের মানুষদের জন্য তাই খুব কষ্টকর হয়ে পরে রোগীর আশেপাশে থাকতে। কিন্তু এই সমস্যায় আক্রান্ত মানুষদের আপনজনদের এটা বোঝা খুব জরুরী যে রোগী আসলে সবার সাথে এমন ব্যবহার করতে চায় না। যারা কোন একটি দুর্ঘটনার পর মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে তারা অবশ্যই চায় আবার সুস্থ্য হয়ে উঠতে। তাদেরকে সুস্থ্য করে তুলতে দরকার একটি নিবেদিত চিকিৎসা সেবা, কিন্তু এটি মোটেও সহজ কোন ব্যাপার নয়। রোগীর একার পক্ষে নিজে নিজে সুস্থ্য হয়ে ওঠা একটি প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
এই সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন সময়। যখনই রোগীর মনে হবে সে সুস্থ্য হয়ে গিয়েছে, তখনই তারা নিজেদের আবার আগের অবস্থায় ফিরে পেতে পারে। একজন অভিজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ এই সমস্যার চিকিৎসা খুব ভালোভাবে করতে পারে, কিন্তু এর জন্য আরও প্রয়োজন রোগীর আপনজনদের সাহায্য ও সহযোগিতা। রোগীর আপনজনদের সবসময় পিটিএসডি’তে আক্রান্ত ব্যাক্তির পাশে থাকতে হবে, বিশেষ করে তাদের খারাপ সময়ে। এই সমস্যার সমাধানে অনেক সময় লেগে যেতে পারে, কারন পিটিএসডি’র চিকিৎসায় কোন বাঁধা সময়সীমা নেই।
এই কথাটি তাদের জন্য, যারা পিটিএসডি’তে আক্রান্ত রোগীর খুব কাছের কেউ। অনেক ক্ষেত্রে, আপনার ইচ্ছা হবে প্রিয়জনের কষ্টের দোষ কারো উপর চাপিয়ে দিতে, বিশেষ করে এমন কেউ যে আপনার কাছের মানুষটিকে কষ্ট দিয়েছে। অন্য বেশ কিছু ক্ষেত্রে, পিটিএসডি’র কারন হতে পারে তাদের ভাগ্য, নিয়তি বা দুর্ভাগ্য – অথবা, যেটাই আপনি মনে করেন। কিন্তু আসলে কোন ক্ষেত্রেই এটি আপনার দোষ নয়, এবং আপনার পক্ষে সম্ভব নয় নিজে নিজে এই অসুখের চিকিৎসা বা সমাধান করা। আপ্নাই প্রিয় মানুষটির যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে একজন যোগ্যতাসম্পন্ন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য, যে তাকে ধীরে ধীরে আরোগ্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং তাকে ভালো বোধ করাতে পারবে।
যেসব রোগীদের মধ্যে আমরা পিটিএসডি’র লক্ষন দেখি, তাদের একটি বড় সমস্যা আছে – ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড রকম স্নেহ ও ভালবাসার চাহিদা এবং কারো কাছ থেকে সেটি গ্রহন করার অনিহা, এবং এই দুই বিপরীতধর্মী আবেগের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব। আসলে এই মানসিক সমস্যাটি মূলত হয় কোন হিংস্র অথবা সহিংস ঘটনার মুখোমুখি হলে। এই কারনে পিটিএসডি’তে আক্রান্ত একজন মানুষের পক্ষে কঠিন হয়ে পরে অন্য কারো সাথে কোন শারীরিক সংস্পর্শে আসতে, তা একটি নিরীহ আলিঙ্গন বা সান্তনা দেয়ার কোন স্পর্শ হলেও।
কিন্তু আরোগ্যের পথে (কোন একটি সময়ে) এই ধরণের শারীরিক স্পর্শের সান্নিধ্যে একজন রোগীকে আসতেই হবে, বিশেষ করে এমন কারো সাথে যে তাকে ভালবাসে। কিন্তু প্রিয়জনদের উচিৎ অপেক্ষা করা, যতদিন না পিটিএসডি’তে আক্রান্ত ব্যাক্তিটি মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে পারে তাদের প্রিয়জনদের শারীরিক সান্নিধ্যে আসার। বিশেষ করে আপনি যদি আসলেই রোগীকে ভালোবাসেন এবং তাদের ভালো চান, অপেক্ষা করুন, কারন শুভদিন অবশ্যই আসবে। আর যখনই এই ভালো দিন আসবে, রোগী নিজে থেকেই আপনার দিকে এগিয়ে আসবে আপনাকে আলিঙ্গন করতে। আপনার সান্নিধ্যেই, রোগী আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে পা বাড়াবে।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে