সাংবাদিকতায় একজন পরিচিত মুখ তুষার আব্দুল্লাহ বর্তমানে সময় টিভির বার্তা বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। এছাড়াও লেখক, কলামিস্ট হিসেবে রয়েছে তাঁর পরিচিতি। বর্তমান গণমাধ্যমগুলো ঠিক কীভাবে কাজ করছে, এর সামাজিক প্রভাব কি, এর থেকে সমাজ ও জনগণ মানসিক ভাবে কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। ইত্যাদি নানা বিষয় সহ ব্যক্তিগত জীবন ও ভাবনা নিয়ে তিনি খোলামেলা আলোচনা করেছেন মনেরখবর.কম-এর সাথে। সাথে ছিলেন মুহাম্মাদ মামুন।
[int-quote] দুইটা শিশুকে তাদের মা মেরে ফেললেন। আমরা প্রচার করছি মা ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে মেরে ফেলেছেন, এটা শোনার পর তো বাচ্চারা মায়ের ওড়না শাড়ীর আচল দেখলেই ভয় পাবে। আবার বলা হচ্ছে ঘুমাতে যাওয়ার নাম করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে, এ কথাটাও আমরা প্রচার করছি। এখন কোনো মা যখন তার বাচ্চাকে বলবে চলো ঘুমাতে আসো, তখন বাচ্চা বলবে না তোমার সাথে ঘুমাবো না। এই যে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাটা এটা নিয়ে আমরা চিন্তা করছি না। আমরা প্রতিদিন রক্ত দেখাচ্ছি, কতটুকু ভায়োলেন্স হলো তার বিস্তারিত বলছি। কে কত বিস্তারিত বলতে পারে তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতেছি এতে করে যেটা হচ্ছে, সমাজে ট্রমা তৈরি হচ্ছে। [/int-quote]
কেমন আছেন?
ভালো আছি।
সাংবাদিকতা পেশায় এলেন কেন?
ছোটবেলা থেকেই একটা আগ্রহ ছিল এই পেশার প্রতি। বাবা বাংলাদেশ বেতারে ছিলেন। যার কারণে খবরের ব্যাপারগুলো ছিল। স্কুলে থাকাকালীন বাসায় পত্রিকা বই পড়তে পড়তে এদিকে আগ্রহ তৈরি হয়ে গেল। এরমধ্যে যখন তেজগাঁও বালক বিদ্যালয়ে ক্লাস সিক্স সেভেনের দিকে পড়ি তখন শিশুকন্ঠ নামের একটি পত্রিকা বের হতো বাচ্চাদের নিয়ে, আমি সে পত্রিকার স্কুল প্রতিনিধি হয়ে গেলাম। তখন থেকেই পত্রপত্রিকা পড়া লেখালেখি করা এভাবেই এসএসসি পরীক্ষা দিলাম সেই নব্বইয়ের দিকে। তারপর সাপ্তাহিক মুদ্রা দিয়ে সাংবাদিকতায় অভিষেক।
বর্তমানে আপনি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের নিউজ হেড। আপনাদের প্রচারিত সংবাদগুলো মানুষের মধ্যে বা সমাজে কী ধরনের মানসিক প্রভাব ফেলছে বলে আপনি মনে করেন?
ভিজ্যুয়াল এনথ্রোপলজির দিক থেকে অথবা নৈতিকতার দিক থেকে যদি বলি তাহলে বলতে হয়, গণমাধ্যম বা টেলিভিশনগুলো প্রতিদিনই অপরাধ করছে। আহাজারির যে বিষয়টা অর্থাৎ একটি সংবাদে শিশুটিকে কীভাবে হত্যা করা হলো বা ব্যক্তিটিকে কীভাবে কোপানো হলো অথবা কীভাবে এসিড দিয়ে ঝলসে দেয়া হলো এসব বিস্তারিত দেখাচ্ছি। দেখাতে দেখাতে যে আহাজারির কথা বলছি যা সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।
বিস্তারিত দেখানো হচ্ছে কেন?
এর একটা কারণ হচ্ছে আমাদের আগের যে প্রজন্ম আর আমাদের যে প্রজন্ম তাদের স্কুলিং অর্থাৎ শিক্ষা পদ্ধতি এক নয়। আমাদের আগের প্রজন্ম কাজ করেছে যে ধরনের পত্রিকাগুলোতে সেখানে যে ভাষা ছিল পরিবেশ ছিল তার থেকে আমরা আলাদা। নব্বই পূর্ববর্তী যারা পত্রিকাগুলোতে কাজ করেছেন তাদের মানসিকতা এক রকম তাদের চিন্তা ভাবনা এক রকম আবার আমরা যারা নব্বই পরবর্তী তাদের অন্য রকম। আগের প্রজন্ম অনেকটা আহাজারি বা কান্নাকাটি পছন্দ করেন। কিন্তু এই আহাজারিটা শুধু ছোটদের মনস্তত্ত্বের জন্যই না, বড়দের মনস্তত্ত্বেও আঘাত হানছে। আর এদিকে আমাদের বলে দেয়া হচ্ছে যে শিশুটিকে কীভাবে হত্যা করলো মানুষটিকে কীভাবে গুলি করে মারলো এগুলোর ছবি পর্যন্ত আমরা দেখাচ্ছি। এগুলো আমরা প্রতিদিনই করছি তার আরেকটা কারণ প্রতিযোগিতা। এটা শুধু বাংলাদেশে না, সারা পৃথিবীতেই একটি পুঁজির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। এইযে প্রতিযোগিতা দর্শক টানার প্রতিযোগিতা, এটা করতে গিয়ে আমরা প্রতিদিনই অপরাধ করছি। একে আমি ভুল বলব না, অপরাধ বলব।
মিডিয়ার এই আচরণে সমাজ কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?
যেমন এইযে দুইটা শিশুকে তাদের মা মেরে ফেললেন। আমরা প্রচার করছি মা ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে মেরে ফেলেছেন, এটা শোনার পর তো বাচ্চারা মায়ের ওড়না শাড়ীর আচল দেখলেই ভয় পাবে। আবার বলা হচ্ছে ঘুমাতে যাওয়ার নাম করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে, এ কথাটাও আমরা প্রচার করছি। এখন কোনো মা যখন তার বাচ্চাকে বলবে চলো ঘুমাতে আসো, তখন বাচ্চা বলবে না তোমার সাথে ঘুমাবো না। এই যে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাটা এটা নিয়ে আমরা চিন্তা করছি না। আমরা প্রতিদিন রক্ত দেখাচ্ছি, কতটুকু ভায়োলেন্স হলো তার বিস্তারিত বলছি। কে কত বিস্তারিত বলতে পারে তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতেছি এতে করে যেটা হচ্ছে, সমাজে ট্রমা তৈরি হচ্ছে।
দর্শকরা কি ভায়োলেন্স পছন্দ করেন?
দর্শকরা পছন্দ করেন কি না করেন তার চাইতে বড় ব্যাপার হচ্ছে আমরা ব্যাপারগুলোতে দর্শকদের অভ্যস্ত করে তুলছি। দর্শক অনেক কিছুই পছন্দ করতে পারেন কিন্তু তাই বলে আমি সেটা দেখাবো কেন। ভিজ্যুয়াল এনথ্রোপলজি আছে নৈতিকতার ব্যাপার আছে আরো অনেককিছু আছে যেগুলো মেনে আমাদের কাজ করতে হবে। কিন্তু আমরা সেগুলো করছি না।
ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি। সাংবাদিকতার পাশাপাশি আপনি লেখালেখিও করেন। ঠিক কোন ধরনের লেখা আপনি বেশি পছন্দ করেন?
প্রথমত আমি একজন সাংবাদিক। তাই শুরুর দিকে গণমাধ্যম নিয়ে লেখালেখি করতাম। তারপর ৯৪/৯৫ সালের দিকে ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখি শুরু করি। ৯৪ সালে আমার প্রথম বই বের হয়। এরপর ইটিভিতে জয়েন করার পর লেখালেখি একটু কমে গেল। তারপর ২০০০ সালের দিকে আবার লেখালেখিতে হাত দেই গল্প লেখার মাধ্যমে। তবে সব মিলিয়ে গণমাধ্যমের উপর লেখা বইয়ের সংখ্যাই বেশি। এবারও গণমাধ্যমের উপর লেখা তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। শিশুদের জন্য ‘তোমরা সুন্দর হও’ এবং ‘ভূতের হাসি’ নামে আমার দুইটি বই বের হয়েছে। এর আগে বের করেছি ‘চল বড় হই’।
শিশু কিশোরদের জন্য বই বের করার অনুপ্রেরণা কীভাবে আসলো?
সচরাচর শিশুদের জন্য যেসব ভূতের গল্প আমরা পেয়ে থাকি সেগুলো অনেকটা ভয়ের বা শুধুই রূপকথার গল্প হিসেবে পাই। আমার কাছে মনে হয়েছে শুধু ভূতের গল্প না হয়ে এমন কিছু হলে যে গল্পের সাথে সাথে শিশু ভাববে স্বপ্ন দেখতে পারবে। এভাবেই আসলে শিশু কিশোরদের জন্য লেখালেখির অনুপ্রেরণা।
শিশুদের জন্য দেশে আলাদা কোনো টিভি চ্যানেল নেই কেন?
শিশুদের ক্ষেত্রে কেউ বিনিয়োগ করতে সেভাবে আগ্রহী নয়। ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজে শিশুদের একটি পত্রিকা করার ব্যাপারে কথা বলেছি কিন্তু সেভাবে সাড়া পাচ্ছিনা।
এর কারণ কী?
এর কারণ হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের কাছে শিশুরাও একেকজন ভোক্তা। যেহেতু শিশুদের জন্য অনুষ্ঠান নির্মাণ অনেক ব্যায়বহুল অনেক বিনিয়োগের ব্যাপার তাই চ্যানেলগুলো শিশুদের অনুষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে আগ্রহী হয় না।
শিশুদের প্রতি এই যে আমাদের অনীহা এর থেকে উত্তরণের পথ কি?
আমাদের সবার মাঝেই একটি শিশুমন থাকার কথা ছিলো, ইন ফ্যাক্ট আছে। নিজের মধ্যে এই যে শিশুমন এটিকে প্রসারিত করতে হবে। শিশুকে একজন ভোক্তা হিসবে দেখার যে প্রবণতা সেটি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
সাংবাদিকতা অনেক ব্যস্ততার একটি পেশা। এই পেশায় থেকে পরিবারের জন্য সময় বের করেন কীভাবে?
সাধারণত চেষ্টা করি অফিসের অবসরের সময়টুকু পরিবারের সাথে কাটাতে। এছাড়া আমার বাচ্চা সময় পেলে আমার অফিসে চলে আসে। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, অফিস ছাড়া আমার বাইরে কোনো আড্ডার জায়গা নেই। কাজের বাইরে যতটুকু সময় পাই পরিবারের সাথেই থাকি। অফিস থেকে বাসা, বাসা থেকে অফিস। চেষ্টা করি সবসময় পরিবারের টাচে থাকার বা রাখার।
পরিবারের বাইরে বাবা মা ভাই বোন এদের সাথে ?
আমরা তো যৌথ পরিবারের মতো থাকি। বাবা মা বা আমার স্ত্রীর আত্মীয় স্বজন সবাই একসাথে থাকি।
যৌথ পরিবার প্রথা দিনদিন ভেঙ্গে যাচ্ছে এক্ষেত্রে আপনাকে বেশ ব্যতিক্রম বলা যায়। কিন্তু কেন? যৌথ পরিবারের সুবিধা কী?
এই যেমন আমি আর আমার স্ত্রী অনেকটা স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারি তার অন্যতম একটা বড় কারণ বাড়ির বা সন্তানের ব্যাপারে চিন্তা অনেকটা কম। ও আছে সে আছে কেউ না কেউ দেখছে। কোনো দরকারে কেউ না কেউ পাশে আছে। যৌথ পরিবারে এটা একটা বড় পাওয়া। বিশেষ করে এখনকার বাচ্চাদের তো বড় বন্ধু হয়ে গেছে ট্যাব আর টেলিভিশন। এর কারণ শিশুদের সঙ্গের অভাব। যৌথ পরিবারে থাকার কারণে বাচ্চার সঙ্গের অভাব হচ্ছে না। একটা বৃহৎ পরিমন্ডলে সে বেড়ে উঠতে পারছে।
যৌথ পরিবারের অনেক সমস্যাও থাকে, পারস্পরিক বোঝাপড়া মনোমালিন্য। বলা হয়ে থাকে এসব বোঝাপড়ার অভাবেই যৌথ পরিবার টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়?
হ্যাঁ, যৌথ পরিবারে থাকলে ছাড় দেয়ার ব্যাপার আছে, সহিষ্ণুতার ব্যাপার আছে, পারস্পরিক বোঝাপড়ার ব্যাপার আছে। ইত্যাদি অনেক সমস্যা রয়েছে। কিন্তু তারপরও এসব মানিয়ে চললে দিন শেষে দেখা যাবে একক পরিবারের চাইতে যৌথ পরিবারে লাভের পাল্লাটা অনেক ভারী।
আমরা জানি আপনি নাটকও লিখেন এবং আপনার লেখা বেশকিছু নাটক প্রচারিত হয়েছে। এই যে নাটক সিনেমাতে মানসিক রোগীদের ব্যাঙ্গাত্বক ভাবে উদ্ভট ভাবে দেখানো হয় এটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
আমি নিজেও দেখি মানসিক রোগীদের ব্যাঙ্গাত্বক বা নেতিবাচক ভাবে দেখানো হয়। এটা আমি সমর্থন করি না। এমনকি আমার যেসব নাটক প্রচারিত হয়েছে সেখানে কোথাও এমন কোনো চরিত্র রাখা হয়নি। কারণ ওভাবে দেখালে ঐ গোষ্ঠীকে অবমাননা করা হয় এবং মানসিক রোগের ক্ষেত্রে সমাজে একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মানসিক রোগীদের নেতিবাচক ভাবে দেখিয়ে অনেক নাটক সিনেমা তৈরি হয়েছে কিন্তু আমার মনে হয় এখন এসব বিষয় নিয়ে আমাদের কথা বলার সময় এসেছে যে এটা করা উচিত না।
ধন্যবাদ আপনাকে মনেরখবরকে সময় দেয়ার জন্য।
ধন্যবাদ মনেরখবরকেও