ডা. মুনতাসীর মারুফ : পারিবারিক উদ্যোগ আর আয়োজনে ব্যাংক কর্মকর্তা খায়রুল আহমেদের সঙ্গে বিয়ে হয় জেবুন নাহারের। বিয়ের আগে কয়েকবার সাক্ষাতে হবু স্বামী তাকে জিজ্ঞেস করে, কারো সাথে তার প্রেম আছে বা ছিল কি না? সে জিজ্ঞাসায় অস্বস্তি ও বিব্রতবোধ করলেও তাতে শালীনতার সীমারেখা পেরুনো কৌতূহল ছাড়া অন্যকোনো গন্ধ পায়নি নাহার। কিন্তু বাসর রাতে স্বামী যখন তাকে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও প্রেম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করে এবং কথিত প্রেমিকের পরিচয় প্রকাশের জন্য তার ওপর চাপ প্রয়োগ করে, সে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে। দিন দিন স্বামীর সন্দেহের মাত্রা বাড়তে থাকে। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে নাহার তার অনুপস্থিতিতে গোপনে তার প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল এ অভিযোগ তুলে তাকে গালিগালাজ করে। অফিস থেকে মধ্য দুপুরে না জানিয়ে হঠাৎ করে বাড়ি ফেরে প্রেমিককে হাতেনাতে ধরবে বলে। কোনো প্রমাণ না পেলেও সন্দেহ দূর হয়না স্বামীর। আরো কিছুদিন পার হওয়ার পর নাহারের গায়ে হাত তোলা শুরু করে তার স্বামী। সন্ধ্যায় বা রাতে নাহারের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ঘরের বাইরে ঘোরাফেরা করে, উদ্দেশ্য শাড়ি দেখে সেই প্রেমিক তাকে নাহার বলে ভুল করে কাছে আসবে আর সে তাকে হাতেনাতে ধরতে পারবে। মাঝে মধ্যে সারাদিন অফিস না গিয়ে ঘরে বসে থাকে বা অফিস শেষে ফিরে রাত জেগে বসে থাকে প্রমাণের আশায়। নাহারকে কোনো পুরুষ আত্মীয় বা প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলতে দেয় না। সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানেও তাকে নিয়ে যায় না। অত্যাচারে অতিষ্ঠ নাহার এক সময় তার ননদকে জানায় সব ঘটনা। ননদ এসে সপ্তাহ খানেক ভাই ভাবীর বাসায় থেকে যায়। সে তার ভাবীর চরিত্রে সন্দেহ করা যায়, এমন কোনো আলামত না পেলেও খায়রুল তার বিশ্বাসে অটল থাকে। সে বিশ্বাস করে, তার স্ত্রী গোপনে অন্য কারো সাথে মিলিত হচ্ছে, সে ঘুমিয়ে থাকলে বা বাসা থেকে বেরুলে তার বাসায় পুরুষ মানুষ আসে। স্ত্রী যাতে অন্য কারো সাথে যৌনসম্পর্ক করার মতো শক্তি না পায়, সে উদ্দেশ্যে সে স্ত্রীর ক্লান্তি-দূর্বলতা ও আপত্তি অগ্রাহ্য করে দিনে-রাতে বহুবার শারীরিকভাবে মিলিত হয়। কিন্তু এত সন্দেহ আর অবিশ্বাস সত্ত্বেও সে স্ত্রীকে ত্যাগ করতে রাজি হয় না। স্ত্রীকে এক রাতের জন্যও তার বাবার বাড়িতে রেখে আসতে নারাজ সে। ধীরে ধীরে পরিবারের অন্যান্যদের মধ্যেও ব্যাপারটা জানাজানি হয়। এবং কেউ কেউ প্রথমদিকে খায়রুলের অভিযোগকে গুরুত্ব দিলেও সবাই এক সময় বুঝতে পারে, খায়রুলের সন্দেহ সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। খায়রুল মূলত ভূগছিল সন্দেহ আর ভ্রান্ত বিশ্বাসে মোড়া এক ধরনের মানসিক রোগে। তার অবস্থাটি কেবল প্রেম বা বিবাহ-সম্পর্কের মধ্যে বহুল চর্চিত স্বাভাবিক ঈর্ষা বা অধিকারবোধের বাড়াবাড়ি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। খায়রুলের অবস্থাটিকে প্যাথলজিক্যাল জেলাসি, মরবিড জেলাসি, সেক্সসুয়াল জেলাসি বা ডিল্যুশন অব ইনফিডেলিটি বলা হয়। শেকসপিয়ারের একটি নাটকের চরিত্রের নামানুসারে এ অবস্থাটিকে ওথেলো সিনড্রোমও বলা হয়। জগদ্বিখ্যাত ইংরেজ লেখক, কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়ারের অন্যতম জনপ্রিয় ট্র্যাজেডি ওথেলো এর মূল চরিত্র ওথেলো নানা ঘটনায় তার স্ত্রী ডেসডিমনাকে সন্দেহ করে যে সে পরকীয়ায় জড়িত। বদ্ধমূল এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে সে তার স্ত্রীকে হত্যা করে। পরবর্তীতে জানা যায়, তার সন্দেহ অমূলক ছিল। সে ঘটনার প্রেক্ষিতে অমূলক সন্দেহের এ মানসিক সমস্যার নাম করা হয় ওথেলো সিনড্রোম। ইংরেজ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ জন টড ও কেনেথ ডিউহার্স্ট ১৯৫৫ সালে বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধতে প্রথম এ রোগটির বর্ণনা করেন। নারীদের তুলনায় পুরুষরাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হন। আক্রান্তদের অধিকাংশই বিবাহিত। আক্রান্ত ব্যক্তির নানা আচরণ ও কথায় এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। রোগাক্রান্ত ব্যক্তি সঙ্গী/সঙ্গিনীর বিশস্ততা ও আচরণ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। ফোনে কার সাথে কথা বলছে তা নিয়ে বারংবার জেরা করেন। ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপস ব্যবহারে বাঁধা দেন অথবা পাসওয়ার্ড দাবি করেন। মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটে মেসেজ চেক করেন বা দেখাতে বাধ্য করেন। অনেকে সঙ্গীকে গোপনে অনূসরণ করেন, আগে থেকে না বলে তার কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হন, কর্মক্ষেত্র থেকে ফেরার পর সঙ্গীর কাপড় ও শরীর নানাভাবে পরীক্ষা করেন পরকীয়ার প্রমাণ খুঁজতে। সঙ্গীর স্বাভাবিক সামাজিক আচরণকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেন। অন্যের সঙ্গে মিশতে এমনকি বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে কথা বলতেও বাঁধা দেন বা বলতে দেখলে সন্দেহ করেন ও উত্তেজিত হন। উত্তেজিত হয়ে অনেকে সঙ্গীর গায়ে আঘাত করতে পারেন। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে সঙ্গীকে হত্যাচেষ্টা বা হত্যার ঘটনা যেমন ঘটে, তেমনি আক্রান্ত ব্যক্তিরও আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ে। আক্রান্ত ব্যক্তির সন্তান থাকলে সে-ও ব্যক্তি দ্বারা যেকোনো বিপদের ঝুঁকিতে থাকে। ওথেলো সিনড্রোম ঠিক কী কারণে হয়, তা নির্দিষ্ট করে এখনো বলা যায় না। তবে এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের মতবাদ দিয়েছেন মনোচিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীরা। বংশগতি, বেড়ে ওঠা এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবের পাশাপাশি ব্যক্তির ভালোবাসার অনুপস্থিতি বা ঘাটতির বোধ, আত্মবিশ্বাসহীনতা, নিরাপত্তার অভাববোধ প্রভৃতিকে এ সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার পেছনে ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় বলে মনে করা হয়। কোনো কোনো ব্যক্তি কেবল ওথেলো সিনড্রোম বা প্যাথলজিক্যাল জেলাসিতে ভুগতে পারেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে, সিজোফ্রেনিয়া, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্ব বৈকল্য, যৌনসমস্যা প্রভৃতির লক্ষণ হিসেবে এ সমস্যাটিকে অঙ্গাঙ্গিভাবে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে মূল রোগের চিকিৎসা জরুরি। মূল রোগের ধরনভেদে চিকিৎসা ঔষধ সেবন ও সাইকোথেরাপি দুইভাবেই করা যায়। সন্দেহের কারণে ব্যক্তি নিজের বা সঙ্গীর ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ালে কখনো কখনো তাকে হাসপাতালে ভর্তি করারও দরকার হতে পারে।
লিখেছেন, ডা. মুনতাসীর মারুফ
সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি শহীদ এম. মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ।