আপনি কি মানসিকভাবে সুস্থ?

0
36
যে অভ্যাস রপ্ত করলে বাড়বে স্মৃতিশক্তি

ইতিবাচক মানসিকতা এবং মানসিক দিক থেকে সুস্থ থাকা, এই দুটি প্রায় সমার্থকভাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মানসিক দিক থেকে সুস্থ থাকার বিষয়টি বেশ গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে একটি মানুষ আনন্দে থাকলেও সে যে মানসিক দিক থেকে সুস্থ আছে, সব সময় তা না হতেও পারে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সুস্থ মানসিক অবস্থা হল, যখন একজন মানুষ নিজের কর্মক্ষমতা এবং দক্ষতার সঠিক বিশ্লেষণ করে  দৈনন্দিন চাপের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে উৎপাদনশীল কাজের মাধ্যমে নিজের পরিবার ও গোষ্ঠীর জন্য কিছু অবদান রাখে সক্ষম হন।
আমরা কীভাবে বুঝতে পারব যে আমরা মানসিকভাবে সুস্থ আছি?  
মানসিক সুস্থতার প্রথম পদক্ষেপ হল নিজের মন এবং ব্যক্তিতের সম্পর্কে নিরপেক্ষ ধারনা বজায় রেখে নিজেকে এবং নিজের চিন্তাধারার স্রোতকে সঠিক পথে সঞ্চালনা করা। এইভাবেই আমরা আমাদের ক্ষমতা ও সম্ভাব্য লক্ষ্যে পৌঁছনোর রাস্তা প্রশস্ত করি। মানসিকভাবে সুস্থ থাকার মানে এই নয় যে সবসময় হাসিখুশি থাকতে হবে। বরং এর মানে হল সবসময় প্রাণবন্ত থাকা। বিশেষ করে জীবনে যখন কোনও বিপত্তি আসে তখন ভয় না পেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে কড়া হাতে তার মোকাবিলা করা। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কখনই মানসিকভাবে সুস্থ থাকা যায় না। পারস্পরিক সামাজিক যোগাযোগ আমাদের মানসিকভাবে ভাল থাকা কে খুবই প্রভাবিত করে। বিশেষ করে যখন আমরা ইতিবাচক কোনও বিষয়ের সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করি, তখন মানসিকভাবে অনেকটা প্রাণোচ্ছ্বলতা অনুভব করি। মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে ভাল থাকার জন্য নিজের ও শুভানুধ্যায়ীদের ভূমিকাকে স্বীকার করাটা খুবই প্রয়োজনীয়। এর ফলে নিজের প্রতি যে সন্মান দেখানো হয় ও অপরের কাছ থেকে যে সন্মান পাওয়া যায়, তা মানসিক দিক থেকে ভাল থাকতে সাহায্য করে।
গুরুতর ও দীর্ঘস্থায়ী মানসিক রোগ একটি মানুষের জীবনে অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়ে আসে। মানসিকভাবে সুস্থ থাকার মানে সেই সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করা ও সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ কে স্বীকার করে নিজের আত্মসন্মানকে আবার প্রতিষ্ঠিত করা। একটি কেস স্টাডি দিয়ে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বোঝানো সম্ভব।
দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে গুরুতর সিজোফ্রেনিয়া রোগে ভুগছিলেন শ্রীরাম। তাঁর বয়স এখন ৫২ বছর। এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলি প্রকট হয় তিনি যখন আমেরিকাতে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে ডক্টরেট করছিলেন। নিজের কর্মক্ষেত্রে সারাক্ষণ ষড়যন্ত্রকারী সন্দেহ অনুভব করতেন আর চাপা গলায় দেওয়া হুমকির আভাস তাঁর জীবনকে দুঃসহ করে তুলেছিল। এই পরিস্থিতি সহ্য করতে না পেরে শ্রীরাম দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু সেই সময় তিনি মানসিকভভাবে এতটাই বির্পযস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, সম্পূর্ণভাবে কর্মক্ষমতা হারিয়ে কার্যত ঘরবন্দি হয়ে পড়েন।
এরপর মানসিক চিকিৎসা শুরু হওয়ায় তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকেন। নিজের ক্রমশ ভাল হয়ে ওঠা তিনি নিজে অনুভব করতে পারেন। সময়ের সাথে তিনি মূল স্রোতে ফিরতে শুরু করেন। যদিও শ্রীরাম নিজের মনের মতো চাকরি খুঁজে পাননি, তবে একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শিক্ষকতা করে ভালই আছেন। সদ্য বিয়েও করেছেন। এভাবেই ধীরে ধীরে তিনি তাঁর হারানো সন্মান আর আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্যরা মানসিকভাবে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। এখনও তাঁর চিকিৎসা চলছে। তবে সাম্প্রতিক কিছু বিক্ষিপ্ত অসুবিধা ছাড়া আর কোনো সমস্যাই দেখা যায়নি। শ্রীরাম এই কঠিন রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত করে দিব্যি মাথা উঁচু করে রয়েছেন।
শ্রীরাম মনোরোগ বিশেষজ্ঞয়ের সাহায্যে নিজের জটিল মানসিক সমস্যার সাথে মোকাবিলা করতে পেরেছেন। কিন্তু সাধারণ ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা দেখা না গেলেও আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত। দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততায় আমরা নিজেদের অন্তরের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলি এবং নিজেদের জন্য আলাদা করে সময় বার করতে পারিনা।
একটা সাধারণ ঘটনায় কেন খুশি বা রাগ হয় বা সেটা কেন আমাদের আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানে এইসবের পেছনের কারণগুলো খতিয়ে দেখার সময় আমরা পাইনা। অনেক সময় আমাদের কাজের চাপের সঙ্গে আমাদের মানসিক শক্তির সামজ্ঞস্য না ঘটলে, তার ছাপ শরীর ও স্বাস্থ্যের ওপর পড়ে। দুর্ভাগ্যজনক এই যে আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যে কোনও বিচ্যুতি ঘটতে দেখলে আমরা নড়েচড়ে বসি। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই আমরা মানসিক রোগের কোনও উপসর্গকে গুরুত্ব দিই না। ফলে আমরা অজান্তেই নিজেদের বড় বিপদ ডেকে আনি।
মানসিক রোগের কিছু উপসর্গ আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত। এগুলি হল, নিজের মধ্যে অসুখী ভাবের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া ও ধীরে ধীরে নিজের এবং পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, সবসময় নেতিবাচক চিন্তা করা ও অন্যের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করা, আগের তুলনায় কম আনন্দ অনুভব করা, মানুষের থেকে বা কোনও অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রবণতা প্রভৃতি।
কীভাবে আমরা নিজেদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখব?

  • শারীরিক ও মানসিকভাবে নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখা।
  • কর্মক্ষেত্র ও পরিবারের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলা।
  • এমন কিছু কাজের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে রাখা, যা আমাদের আনন্দ দেয় ও আত্মবিশ্বাস জোগায়। যেমন, খেলাধুলো, নিজের কোনও শখ ইত্যাদি।
  • সেই সমস্ত মানুষের সঙ্গে সময় কাটানো, যাঁরা আমাদের গুরুত্ব দেন।
  • ভাল লাগার মুহূর্তগুলো অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া।
  • নিজের অনুভূতি সম্পর্কে সবসময় সজাগ থাকা।

 
লেখক পরিচিতিঃ ডঃ এস কল্যাণসুন্দরম বেঙ্গালুরুর একজন বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ‘দি রিচমন্ড ফেলোসিপ সোসাইটি’-র সিইও   

Previous articleপরিচর্যার কাজে মহিলাদের দায়িত্ব কমানো প্রয়োজন
Next articleশিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here