অনেকের কাছে পারিবারিক সহিংসতা স্বাভাবিক জীবনের একটি অংশ

0
46

ডা. ফাতেমা জোহরা : অনেকের কাছে পারিবারিক সহিংসতা স্বাভাবিক জীবনের একটি অংশ। শিশুদের সাবলীলভাবে বেড়ে উঠায় এই ধরণের পারিবারিক সহিংসতা সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে । শিশুদের ওপর পারিবারিক সহিংসতা শিশুদের সুস্থতা এবং বিকাশগত বৃদ্ধির ওপর একটি মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যেসব শিশুরা বাড়িতে পারিবারিক সহিংসতা দেখে থাকে তারা প্রায়শই বিশ্বাস করে যে তারা এর জন্য দায়ী, ফলে তারা ক্রমাগত ভয়ের মধ্যে থাকে। এতে তাদের শারীরিক, আচরণগত, মানসিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। তাদের ১৫ গুণ বেশি প্রবণতা থাকে নির্যাতিত হওয়ার। যেসব শিশুরা পারিবারিক সহিংসতা দেখে তাদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে নানারকম মানসিক সমস্যা হতে পারে।

এছাড়াও শিশুরা আচরণগত সমস্যা তৈরি করতে পারে, যেমন সবক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া, যাওয়া, অন্যদের আচরণ অনুকরণ করা। আরও কিছু লক্ষণ
হলো বিছানা ভেজানো, দুঃস্বপ্ন দেখা, বয়স্কদের প্রতি অবিশ্বাস, কঠোর আচরণ করা, অন্য মানুষদের সাথে মিশতে সমস্যা হওয়া এবং তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা। পারিবারিক সহিংসতার আরেকটি আচরণগত সমস্যা হলো শিশুটি দ্বন্দ্ব এবং অতিরিক্ত মনোযোগ এড়াতে মিথ্যা কথা বলে।

শিশুরা এই পারিবারিক সহিংসতার অর্থ বোঝে না এবং তারা বিশ্বাস করতে থাকে যে তারা কিছ ভুল করেছে, তাদের এই বিশ্বাস তাদের ভেতর অপরাধবোধ এবং উদ্বেগের কারণ হয়ে থাকে। ছোটো বাচ্চাদের তাদের অনভুতি মৌখিকভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা থাকে না এবং এই আবেগ আচরণগত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তারা অযৌক্তিক আচরণ এবং কান্নাকাটি করে সমস্যা করতে পারে। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়া শিশুর অন্যান্য সাধারণ আচরণগুলি হলো খাওয়া এবং ঘুমের অসুবিধা। পরিসংখ্যান দেখায় যে একটি শিশু যে তাদের পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের মধ্যে সহিংসতা প্রত্যক্ষ করে তার নিজের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে হিংসাত্মক আচরণ করার সম্ভাবনা বেশি। এমনকি যখন শিশু শারীরিক আঘাত পায় না, তখনও সহিংস কাজগুলি দেখার বা শোনার মানসিক পরিণতিগুলি গুরুতর এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়। প্রকতপক্ষে, যে শিশুরা সহিংসতার সাক্ষী হয় তারা প্রায়ই একই লক্ষণ এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবগুলি অনুভব করে। তারা অত্যাধিক কাঁদে, চিৎকার করে, হজমের সমস্যা হয়, খাওয়ানো এবং ঘুমের রুটিন ব্যাহত হয়, ঘন ঘন অসুস্থ, কম ওজন, ক্ষুধা থাকে না, সহজেই চমকে যায়, বিরক্তি, দুঃখ, উদ্বেগ প্রকাশ করে, নিরাপত্তার অনুভূতির অভাব বোধ করে।

এটা মনে রাখা গুরুত্বপর্ণ যে পারিবারিক সহিংসতার শিকার শিশুরা শারীরিক নির্যাতন এবং অবহেলার মতো অন্যান্য ধরনের অপব্যবহারের ঝুঁকিতে থাকে। গবেষণা পরামর্শ দেয় যে বাবা-মায়েরা একে অপরের সাথে সহিংস হয় তাদের সন্তানদের শারীরিকভাবে নির্যাতনের ঝুকিতে থাকে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে শিশু নির্যাতন এবং পারিবারিক সহিংসতার প্রকাশের পরিণতি প্রায়ই একই রকম। মনে রাখতে হবে আমাদের শিশুদের মানসিক বিকাশে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপর্ণ সেটি হলো পারিবারিক সম্পর্ক। পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে আরো গুরুত্বপর্ণ বিষয় হলো মা-বাবার সম্পর্ক। এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে যদি শিশু নেতিবাচক বিষয় ঘটতে দেখে, তার ভেতরেও নেতিবাচক একটি প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে
পারিবারিক সহিংসতা। পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে মা-বাবার মধ্যে কলহ, মানসিক দ্বন্দ্ব, একে অপরকে দোষারোপের বিষয় এবং সর্বোচ্চ পর্যায় হলো শারীরিক নির্যাতন দেখা যায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন স্ত্রী স্বামী দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে, শারীরিক, মানসিক ও আবেগীয়ভাবে। এটা খুবই ভয়াবহ বলে আমি মনে করি। শিশুর সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক থাকে গভীর। শিশু যখন দেখে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মানুষটি নির্যাতিত হচ্ছে, তার ভেতরে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়। আক্রোশ তৈরি হতে পারে, বিষণ্নতা তৈরি হতে পারে, জেদ তৈরি হয়। সবগুলোই নেতিবাচক। এটি শিশুর জন্য ট্রমা। অনেক সময় এই পারিবারিক সহিংসতার বিষয়টি শিশুর ওপরও পড়ে। মা-বাবা যখন নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, কলহে লিপ্ত হয়, এমনকি শারীরিক নির্যাতনের মধ্যেও চলে যায় তখন শিশু যেহেতু দুর্বল থাকে, হয় বাবা, না হলে মা, শিশুর ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্যাতন করে। নির্যাতনের মধ্যে পড়ে যায় শিশুটি। হয় অবহেলা, হয় আবেগীয় নির্যাতন, হয় শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে শিশুটি পড়ে যায়। এটা এমনিতেই হয়। মা-বাবা যে বিষয়টি ইচ্ছাকৃতভাবে করে সেটি নয়। হয়তো শিশুটির সেবা-যত্ন যেভাবে নেওয়ার কথা, সেটি কমে যায়। এগুলো শিশুর দীর্ঘমেয়াদি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে।

গবেষণাগুলোতে দেখা যায়, পারিবারিক সহিংসতার কারণে শিশুদের মধ্যে মূলত দুই ধরনের মানসিক অসুবিধা দেখা দেয়। এক ধরনের অসুবিধা ভেতরে ভেতরে ঘটে। এটা সব সময় বোঝার উপায় নেই। সাধারণ মানুষ এটা বুঝবে না। আরেকটা হলো বাইরে ঘটে। শিশুটি হয়ত অতিরিক্ত চঞ্চল হয়ে যাচ্ছে, হয়ত পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে যাচ্ছে। এরপর হতে পারে যে স্কুলের ফলাফল খারাপ করছে। একটু যখন বড় হয়, তখন দেখা যায় মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো মা-বাবার সঙ্গে তর্ক করে। এমনকি অন্যকে আঘাত করা বা অন্যকে হত্যা করার মতো পরিস্থিতি তার ভেতর তৈরি হয়। আর অভ্যন্তরীণ বিষয় হলো শিশু যখন বুঝতে পারে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলো মানসিক কষ্টে রয়েছে, সে প্রতিরোধ করতে
পারছে না, তার মধ্যে কিন্তু একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। কারণ, সে এমনিতেই দূর্বল। আর যে তাকে নির্যাতন করছে, পরিবারের নির্যাতনের জন্য দায়ী সে
শক্তিশালী। আবার যাকে করা হচ্ছে সে তার সবচেয়ে কাছের। এতে সে না পারে প্রতিরোধ করতে আর না পারে একে গ্রহণ করতে। এতে তার মধ্যে বিষণ্নতা, রাগ, অসহায়বোধ, আচরণজনিত অস্বাভাবিকতা, আত্মহত্যা করার মতো বিষয়গুলো চলে আসে। এক্ষেত্রে ছোটো বাচ্চারা উদ্বিগ্ন হতে পারে। তারা পেটে ব্যথার অভিযোগ করতে পারে বা তাদের বিছানা ভিজতে শুরু করতে পারে। তাদের ঘুমাতে অসুবিধা হতে পারে, মেজাজ খারাপ হতে পারে এবং এমন আচরণ করতে শুরু করে যেন তারা তাদের চেয়ে অনেক কম বয়সী। তারা যখন নার্সারী বা স্কুল শুরু করে তখন তাদের নির্যাতিত পিতামাতার থেকে আলাদা করা কঠিন হতে পারে। বয়স্ক শিশুরা ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। ছেলেরা তাদের কষ্টকে অনেক বেশি বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করে বলে মনে হয়, উদাহরণস্বরূপ আক্রমণাত্মক এবং অবাধ্য হয়ে। কখনও কখনও, তারা সমস্যাগুলি সমাধান করার চেষ্টা করার জন্য সহিংস ব্যবহার করতে শুরু করে এবং পরিবারের মধ্যে তারা যে আচরণ দেখে তা অনুলিপি করতে পারে। বয়স্ক ছেলেরা অবাধ্য হয়ে খেলা-ধূলা করতে পারে এবং অ্যালকোহল বা ড্রাগ ব্যবহার করতে শুরু করতে পারে (দুটিই বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতিগুলিকে আটকানোর চেষ্টা করার একটি সাধারণ উপায়)। মেয়েরা তাদের কষ্টকে ভেতরে রাখার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তারা অন্য লোকেদের থেকে দূরে সরে যেতে পারে এবং উদ্বিগ্ন বা বিষণ্ন হয়ে পড়তে পারে। তারা নিজেদের সম্পর্কে খারাপ চিন্তা করতে পারে এবং অস্পষ্ট শারীরিক লক্ষণগুলির অভিযোগ করতে পারে। তাদের খাওয়ার ব্যাধি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, বা অতিরিক্ত মাত্রা গ্রহণ করে বা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করে। তারা নিজেরাই অপমানজনক সঙ্গী বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

এবার আসা যাক এই বিষয়ে করণীয় প্রসঙ্গে,

পারিবারিক সহিংসতা এবং অপব্যবহার যাতে শিশুর জন্য লজ্জাজনক বা গোপনীয় না থাকে তা নিশ্চিত করাই প্রথম পদক্ষেপ। পেশাদারদের তাই শিশুদের সাথে কাজ করার সময় এটি মনে রাখা উচিত। পারিবারিক সহিংসতার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলির জন্য, পিতা-মাতা এবং শিশুর চিকিৎসা করা যায়, যেমন পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের শিশুদের জন্য তাদের চিকিৎসা এবং গ্রুপ চিকিৎসা। শিশুরা যখন সঠিক সাহায্য এবং সমর্থন পায় তখন তারা আরও ভালোভাবে মোকাবেলা করতে এবং পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, সহকর্মী, স্কুল থেকে। পারিবারিক সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের কী ঘটছে তা চিনতে দীর্ঘ সময় নেওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ অনেক পরিবারের কাছে পারিবারিক সহিংসতা এবং নির্যাতন পারিবারিক জীবনের একটি ‘স্বাভাবিক’ অংশ। এমনকি বাচ্চারা যখন বুঝতে পারে যে পরিস্থিতি ভুল, তখন লজ্জার কারণে কথা বলা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। যাই হোক, বাড়ির বাইরে একটি বিশ্বস্ত সম্পর্ক থাকলে পারিবারিক সহিংসতার দ্বারা প্রভাবিত কেউ তাদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কথা বলতে পারে। পরিবারের বাইরের কারো সাথে গোপনীয়তা শেয়ার করা সহিংসতা থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম ধাপ। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য পরিদর্শক, শিক্ষক এবং সমাজকর্মীসহ পেশাদারদের পারিবারিক সহিংসতার লক্ষণগুলি পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রয়োজন হলে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক সহিংসতা সংস্থাগুলি সহায়তা নিতে পারেন।
পুনঃ সম্পাদনায়, প্রিন্স মাহামুদ আজিম

লিখেছেন,
ডা. ফাতেমা জোহরা
সহকারী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

Previous articleসোসাইটি ফর সুইসাইড প্রিভেনশনের কমিটি গঠন
Next articleওথেলো সিনড্রোম : নারীদের তুলনায় পুরুষরাই সন্দেহ রোগে বেশি আক্রান্ত হন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here