দেশের ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইনে সহিংসতা, ভয়ভীতি ও উৎপীড়নের শিকার হয়েছে। ইউনিসেফ বাংলাদেশের তৈরি ‘বাংলাদেশের শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তা’ শীর্ষক জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে।
রাজধানীতে গতকাল মঙ্গলবার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জরিপের এ ফল প্রকাশ করা হয়। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে এই অনুষ্ঠান হয়। গতকাল ৫ ফেব্রুয়ারি নিরাপদ ইন্টারনেট দিবস উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)।
দশ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় পড়ুয়া ১ হাজার ২৮১ শিশুর ওপর এই জরিপটি চালানো হয়। এরা প্রত্যেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং ৯৪ শতাংশেরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট আছে।
ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপে অংশ নেওয়া ২৫ শতাংশ শিশু ১১ বছর বয়সের আগেই ডিজিটাল জগতে প্রবেশ করে। শিশুদের একটি বড় অংশ (৬৩ শতাংশ) নিজের ঘরে বসেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে, যা ‘বেডরুম কালচার’অর্থাৎ কম নজরদারির মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে।
ইন্টারনেটে শিশুরা যা করে
ছেলেরা (৬৩ শতাংশ) মেয়েদের (৪৮ শতাংশ) চেয়ে বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে। শিশুরা ইন্টারনেটে সবচেয়ে বেশি যে দুটি কাজ করা হয় তা হচ্ছে, অনলাইন চ্যাটিং (বার্তা আদান-প্রদান) ও ভিডি দেখা। প্রতিদিন গড়ে ৩৩ শতাংশ সময় অনলাইন চ্যাটিং এবং ৩০ শতাংশ সময় ভিডিও দেখা হয়ে থাকে। সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ৭০ শতাংশ ছেলে ও ৪৪ শতাংশ মেয়ে অনলাইনে অপরিচিত মানুষের বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করে। এমনকি জরিপে অংশ নেওয়া ১৪ শতাংশ ইন্টারনেটে পরিচয় হওয়া ‘বন্ধুদের’ সঙ্গে সরাসরি দেখা করেছে।
ইন্টারনেটে শিশুদের বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার বিষয়টিও সমীক্ষায় উঠে এসেছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৯ শতাংশ শিশু ধর্মীয় উসকানিমূলক বিষয়বস্তুর মুখোমুখি হওয়ার কথা জানিয়েছে। কিশোর বয়সীরা (১৬ থেকে ১৭ বছর) অন্য বয়সী শিশুদের তুলনায় অনেক বেশি এই ধরনের উসকানিমূলক বিষয়বস্তুর সম্মুখীন হয়।
অনুষ্ঠানে ইন্টারনেটে শিশুদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, ‘আশা করি, এই মার্চ মাসের মধ্যে প্রযুক্তি এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারব, তাতে পর্নো সাইট বা এই ধরনের বিপজ্জনক সাইটগুলোকে এক জায়গা থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। এই নিয়ন্ত্রণের জন্য কারও কাছে দৌড়াতে হবে না। এটি বড় হাতিয়ার হিসেবে এক হাতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। ইন্টারনেটে যত বড় বিপদ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বিপদ পর্নোগ্রাফি। এর থেকে শিশুদের রক্ষা করতে না পারলে তাহলে বাকি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা যাবে না।’
তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, ‘গত দশ বছরে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮ লাখ থেকে ৯ কোটি হয়েছে। আমরা কী কনটেন্ট দিচ্ছি শিশুদের? দোষ আমাদের। কারণ শিশু উপযোগী কনটেন্ট ইন্টারনেটে আমরা রাখি না। শিশুর পছন্দ, দেশ, সমাজের সম্পৃক্ত এবং মাতৃভাষার সম্পর্কিত কনটেন্ট দরকার। আবার শিশুসহ নাগরিকদের খারাপ কনটেন্ট থেকে রক্ষা করার চেষ্টা আমরা করছি। প্রতিদিন অসংখ্য ছেলেমেয়েরা হয়রানির শিকার হচ্ছে জানতে পারি।
মোস্তফা জব্বার আরও বলেন, রাষ্ট্র শিশুদের জন্য এখনো পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিরাপদ ইন্টারনেট দেওয়ার মতো ব্যবস্থা করে তুলতে পারেনি। এর প্রধান কারণ, যে খারাপ কনটেন্টগুলো শিশুদের কাছে পৌঁছায়, তার উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশে না। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের জন্য।
অনুষ্ঠানে ইউনিসেফের বাংলাদেশিয় প্রতিনিধি এডওয়ার্ড বেগবেদার বলেন, ‘বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠীর কথা আমরা শুনেছি। তারা যা বলছে তা পরিষ্কার- ইন্টারনেট একটি নির্দয় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এ জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট দিবসে ইউনিসেফ তরুণ জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব অনুসরণ করছে এবং অনলাইনে তাদের প্রতি সদয় হতে সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। একই সঙ্গে সবার জন্য, বিশেষ করে শিশুদের জন্য ইন্টারনেটকে নিরাপদ একটি জায়গায় পরিণত করতে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণেরও আহ্বান জানাচ্ছে ইউনিসেফ।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশনের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. নাজমুল ইসলাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মো. সাইমুম রেজা তালুকদার প্রমুখ।