খেলাধুলা মানেই একধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া যেখানে পক্ষ-বিপক্ষ দল থাকে এবং যার সমাপ্তি ঘটে জয় পরাজয়ের মাধ্যমে অর্থাৎ শেষপর্যন্ত একদল জিতবে এবং অন্য দল হারবে।
সুতরাং খেলোয়াড়দের প্রতিনিয়ত বিশাল এক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই চাপকে আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় যদি খেলোয়াড়দের মধ্যে পাস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব থাকে, সমর্থকদের প্রত্যাশা পুরনের চাপ, অধিক দর্শকের চাপ, আবহাওয়ার পরিবর্তন, খ্যাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের কারণে খাপ খাওয়ানোর চাপ, ক্যারিয়ারে নিজেকে টপকানোর বা অন্যের রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন গড়ার চাপ ও সর্বোপরি মিডিয়ার চাপ।
এই অতিরিক্ত চাপই হলো স্ট্রেস, যার মাত্রা স্বাভাবিক মানসিক চাপ থেকে অনেক বেশী হয়। একজন খেলোয়াড় যদি তার স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় বা প্রতিনিয়ত অনিয়ন্ত্রিত চাপের মধ্যে দিয়ে যায় তখন তা তাকে মানসিক, শারীরিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবিত করে। ফলে মানসিক অশান্তি, অল্পতেই মেজাজ হারানো, কাজে কর্মে উৎসাহ না পাওয়া, ভুলে যাওয়া, ঘুমের সমস্যা হওয়া, বিষণ্ণতায় তোগা ইত্যাদি মানসিক সমস্যা হতে পারে, এমনকি আত্মহননের চিন্তাও মাথায় আসতে পারে।
শারীরিক সমস্যার মধ্যে অল্প পরিশ্রমেই অবসাদ্গ্রস্থতা, খিদে কমে যাওয়া, হজমে সমস্যা দেখা দেওয়া, যৌন আগ্রহ কমে যাওয়া, রক্তচাপ, হার্টরেট, মাসল টেনশন বেড়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়াসহ আরও অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। সামাজিক সম্পর্কে জটিলতা, নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়া, একাকীত্বতা, অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াসহ সে মারাত্মক ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে পারে।
এগুলোর কারণে পরবর্তীতে তার পারফরমেন্স ধীরে ধীরে আরও খারাপ হতে থাকে। সুতরাং একজন খেলোয়ারকে হতে হবে আত্বসচেতন, মানসিকভাবে শক্তিশালী ও দৃঢ়চেতা। যারা মানসিকভাবে বেশি দৃঢ় হতে পারবে, তারা খেলায় তত ভালো করবে, দেশ ও জনগনের প্রিয়ভাজন ও আস্থাভাজন হয়ে উঠবে।
মানসিক দৃঢ়তা বাড়ানোর কৌশল একজন খেলোয়াড়কে রপ্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে খেলোয়াড়রা শুধু তার নিজের জন্য খেলে না, তারা একটি এলাকার পক্ষে, গোষ্ঠীর পক্ষে বা একটি দেশের হয়ে খেলে। সুতরাং এগুলো চাপ তো তার জন্য থাকবেই, সে চাইলেও এগুলো উধাও করে দিতে পারবে না। তাই তাকে ইতিবাচক থেকে এসব চাপ বা স্ট্রেস সামলাতে হবে।
ব্যক্তিপর্যায়ে চাপকে ভয় না পেয়ে এটা তার নিজের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। মনের মধ্যে আতঙ্ক চলে এলে পারফরম্যান্স খারাপ হয়ে যায়, মানসিক উত্থান-পতনের কারণে পারফরম্যান্সেও উত্থান-পতন ঘটে। তাই মনঃসংযোগ ধরে রাখার জন্য ধৈর্যশক্তি বাড়াতে হবে।
শিথিলায়ন ও মনের প্রশান্তির জন্য মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন করা যেতে পারে। বুঝতে হবে যেকোনো খেলোয়াড় বা দলের পারফরম্যান্সই ওঠানামা করতে পারে। একদিনের দক্ষতা দিয়ে তো একজন খেলোয়াড়কে বিচার করা যায় না।
আগের দিনের খেলার অভিজ্ঞতা, ভূলত্রুটির বিশ্লেষণ করে পরের ম্যাচের পরিকল্পনা সাজাতে হবে। অভিজ্ঞ পূর্বসুরিদের নিকট থেকে পরামর্শ গ্রহন করতে হবে। তাহলেই একজন মধ্যে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাসের আধার তৈরি হবে যা তাকে নিয়ে যাবে অনন্য এক উচ্চতায়।
ক্রীড়া গবেষক জোনস, হ্যান্টন ও কোন্টন ২০০২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে একজন ক্রীড়াবিদের জন্য মানসিক দৃঢ়তাকে ১২টি বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
১। প্রতিযোগিতা নিজের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষমতার উপর অটল আত্মবিশ্বাস।
২। বাধাবিপত্তি বা প্রতিবন্ধকতার শিকার হবার পরে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়া এবং সফল হবার জন্য অধিকতর দৃঢ়সংকল্পের অধিকারী হওয়া।
৩। নিজের অনন্য ক্ষমতা ও গুণের সুবাদে প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় নিজেকে উন্নত ভাবার ব্যাপারে অটল আত্মবিশ্বাস।
৪। সফল হবার জন্য উচ্চ পরিমাণে আত্মীকৃত প্রেষণা ও চির-অতৃপ্ত বাসনার অধিকারী হওয়া।
৫। প্রতিযোগীতায় উপস্থিত চিত্তবিক্ষিপ্তকারী কারণের উপস্থিতি সত্ত্বেও লক্ষ্যের উপর পূর্ণ মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার ক্ষমতা। ৬। অপ্রত্যাশিত ও অনিয়ন্ত্রণযোগ্য ঘটনা ঘটার পরে মানসিক নিয়ন্ত্রণ পুনরায় জয় করার ক্ষমতা।
৭। প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগীতার সময় কৌশল ও প্রচেষ্টা বজায় রেখে আবেগীয় ও দৈহিক ব্যথা-বেদনা থেকে উত্তরণ করার ক্ষমতা।
৮। প্রতিযোগীতার সময় অনুভূত দুশ্চিতা ও উদ্বেগ মেনে নেওয়া এবং সেগুলিকে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা।
৯। প্রতিযোগীতার চাপের মুখে আরও শক্তিশালী হওয়া।
১০। অন্য প্রতিযোগীদের ভাল বা খারাপ ফলাফলের দ্বারা প্রভাবিত না হবার ক্ষমতা।
১১। ব্যক্তিগত জীবনের চিত্তবিক্ষেপকারী কারণের মুখে পূর্ণ মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার ক্ষমতা।
১২। প্রয়োজন অনুযায়ী ক্রীড়ার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা বা মনোযোগ উঠিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা।
খেলোয়াড়দের মানসিকভাবে ভালো রাখতে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের ভূমিকাঃ পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সতর্ক থাকতে হবে যে তাদের কোন কথাবার্তা বা আচরণ যেন খেলোয়াড়ের মনে বাড়তি চাপ তৈরি না করে। বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সাথে সম্পর্কের উষ্ণতা স্ট্রেসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেকটাই সাহায্য করে।
অভয় দিয়ে ও ইতিবাচক কথার মাধ্যমে তারা খেলোয়াড়দের উৎসাহিত করতে পারে। নেগেটিভ মনোবৃত্তি পরিহার করে তার জন্য সহায়ক ভুমিকা পালন করবে। যথাসম্ভব পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক অন্য বিষয়গুলো যেন তার উপর প্রভাব না ফেলে, সেজন্য সেগুলোর সাথে তাকে না জড়িয়ে পরিবারের অন্য সদস্যরা সেগুলো পালন করবে। পরিবারের সাথে থাকাকালীন তার পর্যাপ্ত অবসর, সুষম খাদ্যভ্যাস ও পরিমিত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।
খেলোয়াড়দের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাঃ খেলোয়াড়দের মানসিক দৃঢ়তা বাড়াতে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিতে হবে। পারফরম্যান্স খারাপ হলে দল থেকে বাদ পড়ে যাব কি না, জনগনের কি প্রতিক্রিয়া হবে, মিডিয়া কি বলবে, এসব নিয়ে খেলোয়াড়রা একধরণের অনিশ্চয়তা বা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে থাকেন।
নিরাপত্তাহীনতাকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে যদি নতুন লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাহলে এটা তার ক্ষেত্রে ভালো প্রভাব ফেলে, কিন্তু নেগেটিভভাবে নিলে কনফিডেন্স কমে যাবে যা তার পারফরমেন্স খারাপ করে দেবে। তবে প্রতিষ্ঠানের উচিত অনিশ্চয়তা বা নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ থেকে একজন খেলোয়াড়কে মুক্ত রাখা।
খেলোয়াড়দের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করা। অন্যায়ভাবে কোনকিছু খেলোয়াড়ের উপর চাপিয়ে দিলে তা তার মনোবল ভেঙ্গে দেবে, ফলশ্রুতিতে তার পারফরমেন্স খারাপ হবে। রেফারী, কোচ, আম্পায়ারদের সাথে খেলোয়াড়দের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হতে হবে।
উন্নত প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। দলের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা সঠিকভাবে চর্চা করতে হবে, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে আবার অনাকাঙ্ক্ষিত অপরাধ করলে তার জন্য জবাবদিহিতার ব্যবস্থাও থাকতে হবে। প্রয়োজনে দেশি-বিদেশী মনস্তাত্ত্বিকদের নিয়ে টিম গঠন করা যেতে পারে, যাদের পূর্বের থেকেই খেলোয়াড়দের মানসিক দৃঢ়তা বাড়ানোতে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
স্বজনপ্রীতি ও দলীয় মনোবৃত্তির চর্চা না করে যোগ্যদের মুল্যায়ন করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে একজন খেলোয়াড়কে চাঙ্গা রাখতে বিভিন্ন পুরষ্কারের ঘোষণার মাধ্যমে তাকে উৎসাহিত করবে, ঝুঁকিভাতার বাবস্থা করতে পারে, নিয়মিত তার মানসিক ও শারীরিক ফিটনেস পরীক্ষা করতে হবে।
মিডিয়ার খবর পরিবেশনে আরও সতর্ক হতে হবে। একদিনের খারাপ পারফর্মেন্সের জন্য তার নেতিবাচকভাবে খবরে আনা যাবে না, এটা তার মনোবল কমিয়ে দিয়ে উলটা মানসিক চাপ বাড়াবে। বরং প্রশংসার মাধ্যমে তাকে অনুপ্রাণিত করবে। তাহলে একজন খেলোয়াড় শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকবে, উপকৃত হবে দেশ, জাতি ও জনগন।
লেখক : ডা. মো. আব্দুল মতিন
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
মানসিক রোগ বিভাগ
রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে
Inspiratory