এম এ কাদের
সারা বিশ্বে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী মানসিক রোগে ভুগছে। বিশ্বে প্রায় ১ শত ৭৫ কোটি মানুষ এই রোগে নীরবে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে। ল্যান্ডসেট জার্নালে প্রকাশিত গত ৩ দশক ধরেই এ অবস্থা বেড়ে চলেছে, গ্লোবাল বারডেন অফ ডিজিজ রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের ১০ শতাংশ রোগের পিছনে উদ্বেগ ও বিষন্নতার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। ১৯৯০ সালে পৃথিবীতে প্রায় ৬৫৪.৮ মিলিয়ন মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিল। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাড়িয়েছিল ৯৭০.১ মিলিয়নে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষ এই রোগে ভুগছে। মানসিক রোগ চিকিৎসায়, অপ্রতুল ব্যবস্থাপনা, কুসংস্কার, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা ও অসচেতনতার কারনে অনেক রোগী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ গ্রামের মানুষ মানসিক রোগকে জ্বীনের আছর মনে করে ভন্ড পীর,ফকির, কবিরাজের কাছে যায়, এতে চিকিৎসার পরিবর্তে উল্টা জটিলতা আরো বেড়ে যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ১৬.১ ভাগ মানসিক রোগে ভুগছে, তাছাড়া ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু কিশোরের মধ্যে ১৮.৪ ভাগই মানসিক রোগে আক্রান্ত। বর্তমানে আমাদের দেশে আশংকাজনকভাবে এই রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানসিক রোগীর ৯২ শতাংশই কোন ধরণের চিকিৎসা, পরামর্শ, সেবা পাচ্ছে না। মাত্র ৮ শতাংশ রোগী কোনরকম চিকিৎসা পাচ্ছে।
মানসিক রোগ দুই প্রকার। নিওরোটিক ও সাইকোটিক। মানসিক রোগের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জেনেটিক বা বংশগত প্রভাব, পরিবেশগত প্রভাব, শারীরিক, মস্তিষ্কের গঠনজনিত সমস্য। প্রধান প্রধান রোগগুলোর মধ্যে বিষণ্নতা, এংজাইটি, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, সাইকোসিস ডিসঅর্ডার, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার, হেলথ এনজাইটি, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসওর্ডার, প্যানিক এটাক ও পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার রোগে মানুষ প্রতিনিয়ত ভুগছে।
পরিবার বা কর্মক্ষেত্রে অবহেলা, পারিবারিক অশান্তি, বাবা মার মধ্যে কলহ ও বিচ্ছেদ, মাদকের আগ্রাসন, প্রযুক্তির অপব্যবহার, কর্মহীন বেকারত্ব, আর্থিক সংকট,অপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থা ও নানাবিধ মানসিক চাপের কারনে মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
মানসিক রোগের লক্ষণ সমূহের মধ্যে রয়েছে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠা, অন্যদের সঙ্গ এড়িয়ে চলা,একটানা ২ সপ্তাহের বেশি বিষন্নতায় ভোগা, অহেতুক অন্যদের সন্দেহ করা, কোন কারণ ছাড়াই নিজের মধ্যে চরম অপরাধবোধ কাজ করা, অতিরিক্ত ভয় বা উদ্বেগ দেখা দেয়া, শরীরের প্রতি যতœ না নেয়া, পড়াশুনা বা পেশাগত কাজে অনীহা দেখা দেয়া, ঘুমের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া বা কমে যাওয়া ও অতিরিক্ত শুচিবাইগ্রস্থ হওয়া।
মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পাবার উপায় : দক্ষ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহন করা, নিয়মিত হাটা ও ব্যায়াম করা, দৈনন্দিন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা, পর্যাপ্ত ঘুমানো ও বিশ্রাম নেওয়া, সুষম ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহন করা, ধূমপানসহ যাবতীয় নেশাদ্রব্য থেকে নিজেকে দুরে রাখা, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা ও পর্ণগ্রাফী দেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখা।
দেশে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সেবার জন্য সরকারি হাসপাতাল আছে মাত্র দুইটি। একটি পাবনায়, ১৯৫৭ সালে ‘শীতলাহ হাউজ’ নামক জমিদার বাড়িতে অস্থায়ীভাবে ৬০ টি শয্যা নিয়ে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করা হয়। পরে ১৯৫৯ সালে জেলা শহর থেকে ৫ কিমি দূরে হেমায়েতপুরে ১১২.২৫ একর জমিতে ২০০ শয্যার হাসপাতালটি স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৬৬ সালে ৪০০ শয্যা, এবং ২০০০ সালে এটিকে ৫০০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা হয়। মোট শয্যার মধ্যে ২৮০ টি নন পেয়িং, ১২০ টি পেয়িং এবং প্রকল্পের অধীনে ১০০ শয্যা রাখা হয়। হাসপাতালে ১৮ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩ টি পুরুষ ও ৫ টি মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট থাকলেও ডাক্তার, নার্স ও জনবল সংকটে চিকিৎসা দারুনভাবে ব্যহত হচ্ছে। এই হাসপাতালে অনুমোদিত ৬৪৩ টি পদের বেশিরভাগই অধিকাংশ সময়েই শূন্য থাকে।
অপরটি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট। ২০০১ সালে শেরে বাংলা নগরে হাসপাতালটি স্থাপিত হয়। ৪০০ টি শয্যার অনুমোদন থাকলেও মাত্র ২০০ শয্যা নিয়ে হাসপাতালটি চলমান আছে। এ প্রতিষ্ঠানেও সেবা পেতে পদে পদে নানা ভোগান্তির কথা শোনা যায়। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কয়েকটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সীমিত আকারে মানসিক রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যনীতি ২০২২ এর তথ্য বলছে, দেশে মানসিক রোগীর বিপরীতে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সংখ্যা একেবারেই কম।দেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছেন মাত্র ৩৫০ জন, সে হিসাবে প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষ মানুষের জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছেন মাত্র ১ জন ও সাইকোথেরাপিস্টের সংখ্যা এর চেয়েও কম।
মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসায় হাজারো সমস্যায় জর্জরিত দুর্দশার চিত্রটি সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিমের মৃত্যুর পর ব্যাপকভাবে সামনে আসে। সরকার অনুমোদিত বেসরকারী মানসিক হাসপাতালগুলোর বেশিরভাগই গড়ে উঠেছে জাতীয় মানসিক ইন্সটিটিউটের আশেপাশে, অর্থাৎ মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোড, বাবর রোড, তাজমহল রোড, শ্যামলী, আদাবর , ফার্মগেট ও গ্রীনরোড এলাকায়। বেশিরভাগ রোগী জাতীয় মানসিক ইন্সটিটিউটে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে এসব প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হচ্ছে।
এইসব প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর সরকারী শর্তানুযায়ী প্রতি ১০ জন রোগীর জন্য নিউরোলোজিস্টসহ ৩ জন ডাক্তার, ৬ জন নার্স ও ৩ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকা বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে এর কোনো মিল পাওয়া যায় না। তাছাড়া অনেকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের অনুমোদন নিয়ে মানসিক রোগের চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর খাবার-দাবার ও পরিবেশ একেবারেই মানসম্মত নয়।তাছাড়া প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে দীর্ঘমেয়াদী এ চিকিৎসা ব্যয় অত্যন্ত বেশি যা সাধারণ মানুষের পক্ষে চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর।
অবহেলা, দুর্দশায় জর্জরিত মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা কিছুটা নিশ্চিত করতে প্রত্যেক সরকারী ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোতে মানসিক রোগ নিরাময় ইউনিট চালু করতে হবে। জেলা ও উপজেলা সরকারি হাসপাতালগুলোতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও সাইকোথেরাপিষ্ট নিয়োগ দিতে হবে। মাদক অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে, শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন করে কোমলমতি শিশুদের বই এর চাপ কমাতে হবে, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং ও ইভটিজিং বন্ধ করতে হবে, পরিবার ও কর্মস্থলে অবহেলা বন্ধ করে তিরষ্কার নয় কাজে উৎসাহ যোগাতে হবে, যতদুর সম্ভব বেকারদের কর্মের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সম্ভব হলে বেকার ভাতা চালু করতে হবে।
দুর্দশাগ্রস্থ মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা খাতের দিকে এখনই নজর না দিলে আগামী কয়েক বছরে মানসিক রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে যা সামাল দেওয়া অত্যন্ত দুরূহ হয়ে উঠবে। ফলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী কর্মক্ষমতা হারিয়ে পরিবার, সমাজ ও দেশের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক :
সাংবাদিক ও কলামিষ্ট