অপরিণত বয়সে বিয়ে : শারীরিক ও মানসিক সমস্যা

দোলন ও চাঁপা, দুই সখীতে বড়ই সখ্য। আর হবেই বা না কেন? একই সাথে বেড়ে ওঠা, একই পথে চলা, একই স্বপ্নে জেগে ওঠা। শৈশবকাল থেকেই তারা স্বপ্ন দেখতো লেখাপড়া শেষে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, স্বাবলম্বী হওয়ার। জীবনের এই লক্ষ্যে যখন তারা দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই তাদের পথ যেন বেঁকে গেল।

মাধ্যমিক পর্যায়ের শেষপ্রান্তে তাদের একজন যখন চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক তখনই আরেকজনকে জীবনের অন্যরকম এক পরীক্ষার মুখোমুখি ঠেলে দেয়ার প্রস্তুতি চলছিলো; স্বামী, সংসার সম্পর্কে কোনো ধারণা জন্মানোর আগেই মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা। ফলে একজন স্বপ্নডানায় ভর করে আলোকিত জীবনের দিকে এগিয়ে যায় আর আরেকজন তার কিশোরী মনের হাজারো স্বপ্নের জলাঞ্জলি দিয়ে অন্ধকারের পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়।

বিয়ের পর কাঁধে চাপানো সকল কাজের বোঝা নিয়ে পথ চলতে শুরু করলেও ভুল-ত্রুটিতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন যেন তার নিত্যদিনের সাথী হয়ে দাঁড়ায়। বছরের পরিক্রমায় দোলন উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয় আর চাঁপাকে গর্ভকালীন জটিলতায় মুমূর্ষু অবস্থায় ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে।

বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে অপূর্ণ বয়সে বিয়ে বা বাল্যবিবাহ অন্যতম একটি সমস্যা। দেশে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে মেয়েরা। যার ফলে বাড়ছে নারী নির্যাতন এবং ঘটছে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর হলেও প্রায় অধিকাংশ মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সের মধ্যে। বাল্যবিবাহের প্রচলন আছে এমন ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

যে সময় একজন মেয়ের স্কুলে যাওয়ার কথা সেই সময় তাকে ধর্ম ও সামাজিক নিরাপত্তার অজুহাত দিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লেখাপড়া ও খেলার সময়ে বিয়ে দিয়ে অন্য একজনের পুতুল খেলার সামগ্রী হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলেই বেশি হচ্ছে অপূর্ণ বয়সে বিয়ে।

নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা, অসচেতনতা, কুসংস্কার, সামাজিক প্রথা, যৌতুক প্রথা, মেয়েশিশুর সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, পারিবারিক প্রতিশ্রুতি পূরণ, সামাজিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য ইত্যাদি কারণসমূহই মূলত দায়ী অপূর্ণ বয়সে বিয়ের জন্যে।

শারীরিক ও মানসিক পূর্ণতা প্রাপ্তির আগেই অপূর্ণ বয়সে বিয়ের মধ্য দিয়ে এক ঝুঁকিপূর্ণ ও দূর্দশাগ্রস্ত দাম্পত্য জীবনের দিকে মেয়েশিশু বা কিশোরীকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বাস্তবে আমাদের দেশে কোনো কোনো শিশুর এতো অল্প বয়সে বিয়ে হয় যখন তাদের কাছে বিয়ের অর্থই পরিষ্কার থাকে না।

বিয়ের আগে একজন নারীর শরীর ও মন বিয়ের উপযুক্ত হওয়া খুবই জরুরি। যদি এই উপযুক্ত সময়ের আগে বিয়ে দেয়া হয় তাহলে তার শরীর ও মনে নানারকম খারাপ প্রভাব পড়ে। অল্প বয়সে বিয়ের ফলে একজন নারী, একটি পরিবার ও পুরো সমাজকে নানামখী সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।

দেশের কিশোরীদের প্রায় ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশই অপুষ্টির শিকার। এর মধ্যে বিয়ের পরই স্বামী ও পরিবারের অন্য সদস্যরা সন্তানের মুখ দেখতে চায়। এক বা দুই বছরের মধ্যে সন্তান না হলে স্বামী যদি বংশ রক্ষার জন্য আবার বিয়ে করে ফেলে সেই ভয়ে মেয়ের বাড়ি থেকেও সন্তান গ্রহণের জন্য মেয়েটিকে চাপ দিতে থাকে। যেখানে সে নিজেই একজন শিশু সেখানে জন্ম নেয় আরো একটি শিশু।

মাতৃত্ব গ্রহণের জন্যে শারীরিক ও মানসিক পূর্ণতা বা দক্ষতা অর্জনের আগেই তাকে সন্তান ধারণে বাধ্য করা হয়।

প্রসঙ্গত, ইউনিসেফ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেয়েদের বাল্যবিবাহের কারণে বছরে ২ লাখ শিশুর জন্ম হয় স্বল্প ওজন ও মারাত্মক অপুষ্টি নিয়ে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গর্ভধারণ সংক্রান্ত জটিলতায় বাংলাদেশে বছরে প্রতি হাজারে ৫ জন মা মারা যাচ্ছে। অথচ এ হার উন্নত দেশে প্রতি লাখে ১ জন। এছাড়া আমাদের দেশে জন্মের সময় প্রতি হাজারে ৯০ জন শিশু মারা যায় ও এক মাস বয়েসী শিশু মারা যায় ৭০ জন।

উন্নত দেশে এ অবস্থায় শিশু মারা যায় ১০ হাজারে ১ জন। কাজেই অপূর্ণ বয়সে বিয়ের ফলে : কম ওজনের শিশুর জন্ম হয়, মৃত শিশুর জন্ম হয়, অনেক সময় জন্মের পর নবজাতকের মৃত্যু হয়। অপুষ্টিজনিত সমস্যার কারণে মায়ের মৃত্যু হয়। মৃত্যু না হলেও মা ও শিশুর অসুস্থতা লেগেই থাকে শিশু লালনপালন সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জনের আগেই মা হওয়ার ফলে জন্ম নেয়া শিশুরা মায়ের সঠিক পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত হয়।

অল্প বয়সে সন্তান জন্মের সময় মায়েদের জরায়ু ছিঁড়ে যাওয়া এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে পরবর্তীতে তাদের বন্ধ্যাত্ব সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জরায়ুতে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। যৌন স্বাস্থ্যেরও হানি হয়।

অন্যদিকে অপূর্ণ বয়সে বিয়ের ফলে মেয়েশিশুদের ব্যক্তিগত বিকাশ বা উন্নয়নের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। যেখানে ভোটাধিকার কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়ন করার ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর, সেখানে তার আগেই বিয়ে দিয়ে একজন কন্যাশিশুর কাঁধে গৃহস্থালির সব কাজকর্ম থেকে শুরু করে শিশু লালনপালনের মতো বিশাল দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়।

জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ মেয়েরা সংসারে নানাভাবে নির্যাতিত হয়। এ অবস্থায় অনেক সময় তাদের মনের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের দুঃখ, কষ্ট, চাপ, দ্বন্দ্ব বাসা বাঁধে। কিন্তু এসব মানসিক সমস্যাকে মেনে নিয়ে পথ চলার বা সমস্যার সমাধান করার কিংবা মন খুলে কাউকে সমস্যার কথা বলার মতো উপযুক্ত পরিবেশ তথা ক্ষমতা তাদের থাকে না। ফলে না বলা আবেগগুলোই একসময় বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে রূপান্তরিত হয় বা মানসিক রোগ সৃষ্টির সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

অপূর্ণ বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে যেসব মানসিক রোগ হতে পারে সেগুলো হলো :

  • বিষণ্ণতা রোগ ((Depressive Disorder)
  • উদ্বেগজনিত রোগ (Anxiety Disorder)
  • মানসিক সমস্যায় শারীরিক রোগ (Somatic Symptoms Disorder)
  • রূপান্তরিত রোগ (Conversion Disorder)
  • মানসিক চাপজনিত রোগ (Stress Related Disorder)
  • খাদ্যাভ্যাসজনিত রোগ (Eating Disorder)
  • নিদ্রাজনিত রোগ (Sleep Disorder)
  • ব্যক্তিত্বের সমস্যা (Borderline Personality Disorder)
  • যৌন রোগ (Sexual Dysfunctions)
  • মাদকাসক্তি রোগ (Substance Related Disorder)

অপূর্ণ বয়সে বিয়ে স্কুলে যাওয়ার উপযোগী মেয়েদেরকে শিক্ষার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করে। বাল্যবিবাহের ফলে বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা ও দক্ষতা লাভের পথ বন্ধ হয়ে যায়। জীবিকার সংগ্রামে পিছিয়ে পড়ে তারা। ফলে সমাজ ও পরিবার মেয়েশিশুদের ভবিষ্যতের সৃষ্টিশীল অবদান থেকে বঞ্চিত হয়।

দক্ষ জনশক্তি থেকে বঞ্চিত হয় অর্থনীতি। আবার কিশোর বয়সের আনন্দ উন্মাদনা থেকে বঞ্চিত মেয়েটি যখন দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করে বিশাল দায়িত্বের ভার মাথায় বহন করে তখন অনেক সময় তার অপরিপক্কতার কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনাও ঘটে। কা

জেই অপূর্ণ বয়সে বিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন বেগবান করার কোনো বিকল্প নেই। বাল্যবিবাহের বোঝা মাথায় দিয়ে কিশোরীদেরকে অন্ধকারে নিমজ্জিত না করে তাদের জীবনকে আলোকিত করার দায়িত্ব যেমন একটি পরিবারের তেমন সমাজেরও বটে।

লেখক : অধ্যাপক ডা. সুস্মিতা রায়
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ

আরো পড়ুন…
কাজে মনোযোগ দিতে পারি না
ধর্ষণের পর আত্মহত্যা : প্রতিরোধে প্রয়োজন মানসিক সাপোর্ট

/এসএস

Previous articleজরায়ুর ইনফেকশন : কারণ ও করণীয়
Next articleসাপে কাটলে সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here