ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সোস্যাল সায়েন্স রিসার্চ এন্ড রিভিউ এ এ বছর মার্চে প্রকাশিত একটি আর্টিকেল থেকে জানা যায় সম্প্রতি আমাদের দেশের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের ধরণের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে।
আগে নারী পুরুষের ঘনিষ্ট সম্পর্ক বলতেই যেমন দাম্পত্য সম্পর্ক বুঝাতো এখন তেমন বুঝায় না। প্রাক বিবাহ বা প্রিম্যারেইটাল, বিবাহ বহির্ভুত বা এক্সট্রাম্যারেইটাল সম্পর্কগুলোকেও এখন ধরতে হবে। কারণ এ ধরণে সম্পর্কের পরিমান এখন বেড়ে গিয়েছে।
আমরা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বলতে সেই সম্পর্কগুলোকে বুঝি যেখানে পরস্পরের মধ্যে জোড়ালো মানসিক বন্ধন থাকে, আবেগ থাকে, অধিকার বোধ কাজ করে। পরস্পর পরস্পরের আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আচরনের পরিবর্তন করে।
- দু’জন নারী-পুরুষের মাঝে এই সম্পর্কটা আইনগত হলে দাম্পত্য সম্পর্ক, আইনগত ভিত্তি না থাকলে প্রাক বিবাহ সম্পর্ক, বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্ক।
সম্পর্ক যে ধরণেরই হোক না কেন মানুষ সম্পর্ক করে সুখী হওয়ার জন্য তথা নিসঙ্গতা, একাকীত্ব, যৌনতা, প্রজনন ইত্যাদি প্রকিয়ায় জীবন উপভোগ উপভোগ করার জন্য। মার খাওয়া, শাসানো, হুমকি, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, অপমান, মানসিক নির্যাতন, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া, উপেক্ষা করা; এসবের জন্য মানুষ সম্পর্ক গড়ে না। কিন্তু তারপরেও এ ধরণের ঘটনা ঘটে।
ঘনিষ্ট সম্পর্কের মধ্যে একজন সঙ্গী যখন অপর সঙ্গীর দ্বারা নির্যাতিত হন, দুর্ব্যবহারের শিকার হন তখন আমরা এ ধরনের নির্যাতনকে বলি অন্তরঙ্গ সহিংসতা। অন্তরঙ্গ সহিংসতা শারীরিক, মানসিক দুভাবেই হয়। সাধারনত চার ধরনের অন্তরঙ্গ সহিংসতা দেখা যায় :
এক. শারীরিক সহিংসতা : সঙ্গী যদি শারীরিক ভাবে আঘাত করে যেমন কিল-ঘুষি মারা, গলা চেপে ধরা, পিটানো, লাথি মারা ইত্যাদি।
দুই. নজড়দারি বা স্টকিং : সঙ্গী যদি সব সময় নজড়দারির মধ্যে রাখে, ঘর বা কর্মক্ষেত্রের বাহিরে অনুসরন করে, গোয়েন্দাগিরি করে।
তিন. যৌন সহিংসতা : সঙ্গী যদি মতামত না নিয়ে জোর করে যৌন সম্পর্ক করে, বা অন্য কোনভাবে যৌন নির্যাতন করে।
চার. মানসিক সহিংসতা : ভয় দেখানো, ছোট করা, হেয় করে কথা বলা, অপমান করা এসব কিছুই মানসিক নির্যাতনের মধ্যে পরে।
শুধু বিবাহিত বা দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে নয়। প্রাক বিবাহ, বিবাহ বহির্ভুত যেকোনো সম্পর্কের মধ্যেই এ ধরনের আচরন অন্তরঙ্গ সহিংসতা বলে গন্য হবে। এ ধরনের আচরনের ফলে ভিক্টিম শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
শারীরিক আঘাতের জন্য তাকে বারবার হাসপাতালের জরুরী বিভাগে যেতে হয়। ঘন ঘন ব্যথার ঔষধ, এন্টিবায়োটিক খেতে হয়। আঘাতের মাত্রা তীব্র হলে হাড় পর্যন্ত ভেঙে যায়। মৃত্যুর ঘটনাও পাওয়া যায় হাসপাতালের রেকর্ড থেকে।
মানসিকভাবে যেমন ফ্লাশব্যক হয় কারো কারো প্রচন্ড মারের কারনে তেমনিভাবে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, প্যানিক ডিজঅর্ডার, ঘুমের মধ্যে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখা এগুলোও ঘটে শারীরিক নির্যাতনের কারনে।
ভিক্টিমের আত্মবিশ্বাস ভেঙে যায়। অন্যের প্রতি আস্থা রাখা, কোনো সম্পর্কের মধ্যে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। যন্ত্রচালিতের মতো সে জীবন যাপন করে যায় মাত্র। প্রতিবাদ করতে পারে না, সাহসে কুলায় না। অসহায় বোধের কারনে কষ্টকর জীবন থেকে বের হওয়ার মতন সাহস থাকে না।
কেউ কেউ খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়, বিষন্নতায় ভোগে। অনেকে আবার নেশায় জড়িয়ে পড়ে। কখনো কখনো আত্মহত্যা প্রবন হয়ে ওঠে। অন্তরঙ্গ সহিংসতার পরিনতি মারাত্মক বলেই এটা একটি পাবলিক হেলথ বিষয়।
অন্তরঙ্গ সহিংসতা শুরু হয় কখন থেকে?
বয়সন্ধি কাল থেকেই অন্তরঙ্গ সহিংসতা শুরু হয়। বিপরীত লিঙ্গের কাউকে মানসিকভাবে হেয় করা থেকে শুরু করে শারীরিকভাবে আঘাত করা পর্যন্ত সহিংস আচরনগুলো অন্তরঙ্গ সহিংসতার মধ্যে পড়ে।
কারা ভুক্তভুগী?
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, গৃহ সহিংসতা বা গৃহ নির্যাতন ইত্যাদি বিষয় ভিত্তিক গবেষনায় দেখা গেছে বাংলাদেশে শতকরা ১৫ থেকে ৮০ ভাগ নারী গৃহ নির্যাতনের শিকার। হাসপাতাল জরীপে দেখা গেছে ৪৩ ভাগ নারী নির্যাতনের শিকার। এদের মধ্যে ৩৫.৫ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার এবং ৩২.৫ শতাংশ যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার।
পুরুষরা যে নির্যাতিত হন না তা নয়। তবে পুরুষদের নির্যাতিত হওয়ার সংখ্যা অনেক কম। পুরুষরা বেশী নির্যাতিত হন মানসিকভাবে। যদিও বাংলাদেশ গৃহ নির্যাতন আইন ২০১০ অনুসারে ভিক্টিম হিসেবে নারী ও শিশুদেরকে গন্য করা হয়। পুরুষকে দেখা হয় নির্যাতনকারী হিসেবে।
ইউএস গভার্মেন্ট এর হিসেব মতে সেদেশে প্রতি দশ জন পুরুষের মধ্যে একজন পুরুষ নির্যাতিত হন এবং প্রতি চার জন নারীর মধ্যে একজন নারী নির্যাতিত হন।
অন্তরঙ্গ সহিংসতার ফলাফল :
- হত্যা
- আত্মহত্যা
- পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার
- বিষন্নতা
- মাদকাসক্তি
- আচরনগত আসক্তি
- সেক্সুয়াল ডিজফাংশন
- সেক্সুয়াল প্রমিজকুইটি বা বাঁধ বিচারহীন যৌনতা
তাহলে সমস্যাটা কত বড়?
আঘাতজনিত চিকিৎসা খরচ বাংলাদেশেরটা বলতে না পারলেও আমেরিকার খরচ থেকে ধারণা করা যেতে পারে। সেখানে বাৎসরিক ব্যয় ৩.৬ ট্রিলিয়ন ডলার। এটা শুধু চিকিৎসা ব্যয় নয়, আনুষঙ্গিক আরো অনেক বিষয় এখানে আছে।
যেমন : অসুস্থতা জনিত ছুটি, নষ্ট হওয়া কর্মঘন্টার আর্থিক হিসেব। এরকম আরো অনেক কিছু। আমাদের দেশের আঙ্গিকে চিন্তা করলে বলা যেতে পারে ব্যয় আমেরিকার সমান না হলেও টাকার অঙ্কটা একেবারে কম হবে না। আর এ কারনেই বিষয়টা পাবলিক হেলথ ইস্যু বা গণস্বাস্থ্যের বিষয়।
কিভাবে সমাধান করা যেতে পারে?
স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক প্রশিক্ষণ : সম্পর্ক নিপীড়ন ধর্মীয় হবে নাকি স্বাস্থ্যকর সুন্দর হবে তা নির্ভর করে আমাদের দক্ষতার উপর। প্রশিক্ষনের মাধ্যমে সেই দক্ষতার পরিবর্তন করা যায়। তরুনদের সোস্যাল ইমোশনাল লার্নিং প্রোগ্রাম করা যেতে পারে। দম্পতিদের প্রশিক্ষন দেওয়া যেতে পারে স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে।
পরিবারভিত্তিক প্রশিক্ষন : সামাজিক কর্মসূচীর আওতায় পরিবারভিত্তিক প্রশিক্ষন দেওয়া যেতে পারে । পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন জন্য কর্মসূচী গ্রহন করা যেতে পারে।
যেভাবে আমরা উপকৃত হতে পারি : সমাজ বা রাষ্ট্র অনেক কিছুই করতে পারে অন্তরঙ্গ সহিংসতা কমাতে। আমরাও ব্যক্তিগত জীবনে আমাদেরকে সাহয্য করতে পারি। আমরা আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। অন্যেকে যথাযথ সম্মান দেওয়ার মাধ্যমে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে পারি।
লেখক : ডা. আতিকুর রহমান, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
ডা. আতিকুর রহমানের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন :