শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
মৃগীরোগ বা আরো সহজ বাংলায় খিঁচুনি রোগ একটি অতি প্রাচীন এবং গুরুতর স্নায়বিক অসুখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৫০-৬৯ মিলিয়ন মানুষ এই রোগে ভুগছে। যদিও এটি একটি স্নায়বিক অসুখ কিন্তু এর সাথে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা বা মানসিক রোগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মত দিয়েছেন। যেমন, ধারণা করা হয় যে, কিছু কিছু খিঁচুনির ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের যে অংশ থেকে খিঁচুনি রোগের উৎপত্তি, সেই একই অংশ থেকে মানসিক রোগেরও উৎপত্তি হয়ে থাকে।
সেই সাথে খিঁচুনি রোগের জন্য যে ওষুধ সেবন করা হয়, সেসকল ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে; তবে সেটি সবার ক্ষেত্রে বা সবসময় নয়। এক্ষেত্রে ওষুধের ধরন, ডোজ, যিনি খাচ্ছেন ঐ ওষুধের প্রতি তার সংবেদনশীলতা ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
এটিও পড়ুন…
পরিবার যেভাবে সদস্যদের মানসিক রোগ শনাক্ত করবে
মৃগীরোগীদের মানসিক রোগ তৈরিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মৃগীরোগীদের প্রতি আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। মৃগীরোগের ইতিহাস যেহেতু অনেক পুরোনো, তাই একে ঘিরে কুসংস্কারের শুরুটাও প্রাচীন। একসময় ধারণা করা হতো যারা মৃগীরোগে আক্রান্ত, তাদের ওপর শয়তান বা খারাপ আত্মার ভর আছে।
এদের সংস্পর্শে কোনো সুস্থ লোক আসলে তাকেও শয়তান আক্রান্ত করতে পারে ফলে এ ধরনের রোগীদেরকে প্রায় একঘরে করে রাখা হতো এবং এদের সাথে অন্যদের মেলামেশা করা নিষেধ ছিল। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই ধারণার যে খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে তা নয়।
এখনো আমাদের সমাজে মৃগীরোগীদের অন্যচোখে দেখা হয়। বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদের মৃগীরোগে আক্রান্ত বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেন না এবং বড়োদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। এমনকি উন্নত বিশ্বেও এই বৈষম্য বিদ্যমান।
ছোটোবেলা থেকে সমাজের এরকম বৈষম্যের শিকার হতে হতে মৃগীরোগীদের মাঝে বিষণœতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, স্কুলে না যাওয়ার প্রবণতা ফলস্বরূপ লেখাপড়ায় পিছিয়ে যাওয়া, সামাজিক দক্ষতার অভাব এবং পরবর্তিতে হতাশাগ্রস্ত হয়ে মাদকাসক্তি বা অন্যান্য অপরাধমূলক ও অসামাজিক কর্মকাÐে জড়িয়ে পড়া এমনকি আত্মহত্যার চিন্তাও আসতে পারে।
গবেষণায় পাওয়া গেছে, মৃগীরোগে আক্রান্ত প্রায় ২০-৩০% রোগীদের মাঝে মানসিক রোগ থাকতে পারে। আবার সব মৃগীরোগে এই মানসিক সমস্যার হার একরকম নয়। কিছু নির্দিষ্ট ধরনের মৃগীরোগে অন্যান্য মৃগীরোগের তুলনায় অনেক বেশি মানসিক সমস্যা দেখা যায়। সেরকম একটি মৃগীরোগ হচ্ছে টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি বা কম্পলেক্স পার্শিয়াল সিজার।
অন্যান্য খিঁচুনির চেয়ে এই খিঁচুনির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই খিঁচুনি রোগে যে শুধু খিঁচুনির ফলাফলস্বরূপ বিভিন্ন মানসিক সমস্যা হয় তাই নয়, বরং খিঁচুনি রোগের লক্ষনগুলো বিভিন্ন মানসিক সমস্যারূপে প্রকাশ পায়।
যেমন অন্যান্য খিঁচুনিতে মস্তিষ্কে খিঁচুনি শুরু হওয়ার পর বাহ্যিকভাবে রোগীর হাত-পা বা শরীর বাকা হয়ে যায়, ঝাঁকুনি খায়, রোগী দাঁড়ানো অবস্থায় থাকলে মাটিতে পড়ে যায় ফলে কখনো কখনো শরীরে মারাত্মক আঘাতও পায় এমনকি অনেক সময় রোগী প্রস্রাব-পায়খানাও করে দেয়। ফলে সেসময় রোগীর আশেপাশে যারা থাকেন তারা বুঝতে পারেন যে রোগীর খিঁচুনি হচ্ছে।
অন্যদিকে টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সিতে হয়ত মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোবে খিঁচুনি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু বাহ্যিকভাবে খিঁচুনির কোনো সাধারণ লক্ষণ প্রকাশ পায় না বরং রোগী তখন কিছু অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে।
এই অস্বাভাবিক আচরণ হতে পারে নিজের জামাকাপড় ধরে টানা বা খুলে ফেলা থেকে শুরু করে চিৎকার করা, নিজেকে আঘাত করা কিংবা ভাঙচুর করা এমনকি ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া যেকোনো কিছু।
পড়ুন….
যৌন সম্পর্কে চিন্তারোগের প্রভাব এবং প্যানিক ডিজঅর্ডার
সেসময় রোগীকে দেখলে মনে হতে পারে রোগী হয়ত সজ্ঞানেই সব করছে কিন্তু আসলে ঐ মুহূর্তে রোগীর জ্ঞান থাকে না। যার কারণে অনেক বড়ো ধরনের বিপদ ঘটারও সম্ভাবনা থাকে যেমন ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরে পড়ে যাওয়া, আগুনের সংস্পর্শে আসা কিংবা রাস্তায় কোনো গাড়ির সামনে চলে আসা ইত্যাদি।
যেহেতু এসময় রোগীর জ্ঞান থাকে না তাই খিঁচুনি পরবর্তী সময়ে রোগী খিঁচুনি চলাকালীন তার অস্বাভাবিক আচরনের কিছুই মনে করতে পারেন না। অন্যদিকে এই রোগীদের একটি বড়ো অংশই প্রথম পর্যায়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন কারণ রোগীর আত্মীয় মনে করেন তার কোনো মানসিক রোগ হয়েছে যার ফলে তিনি মাঝেমধ্যে এমন আচরণ করছেন এবং পরবর্তিতে ভুলে যাচ্ছেন।
এছাড়া সব মিলিয়ে যেকোনো মৃগীরোগের ক্ষেত্রেও নিম্নোক্ত মানসিক সমস্যা বা মানসিক অসুখগুলো দেখা দিতে পারে :
১. সাইকোটিক ডিজঅর্ডার : সিজোফ্রেনিয়া যার মধ্যে প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এধরনের রোগীদের ব্রেইন ইমেজিং করলে ব্রেইন ভলিউম তথা মস্তিষ্কের আয়তনও স্বাভাবিকের চেয়ে কম পাওয়া যায়।
২. বাইপোলার ডিজঅর্ডার : গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতিবছর ১০০০ জন মৃগীরোগীদের মাঝে প্রায় ১.৬৯ জনের মধ্যে বাইপোলার রোগটি দেখা যায় যেখানে কিনা সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সংখ্যা হাজারে ০.০৭ জন।
৩. ডিপ্রেশন : মৃগীরোগীদের মাঝে মানসিক রোগের ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন বা বিষণœতা রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এর কারণ হিসেবে সরাসরি মস্তিষ্কে মৃগীরোগের প্রভাব এবং মৃগীরোগীদের প্রতি অন্যান্যদের অবমাননাকর আচরণ দুটোই দায়ী।
৪. এংক্সাইটি ডিজঅর্ডার : মৃগীরোগীদের মাঝে অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার বা উদ্বেগজনিত সমস্যাও দেখা যায়। বিশেষ করে, টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সির ক্ষেত্রে এটি হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ১৯ শতাংশ।
৫. পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার : অনেকক্ষেত্রেই দীর্ঘদিন বারবার খিঁচুনি হওয়ার ফলে মৃগীরোগীদের মাঝে ব্যক্তিত্বের সমস্যা দেখা যায়। অনেকের মাঝে তার পূর্বের ব্যক্তিত্ব থেকে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায় যেমন সার্বক্ষণিক খিটখিটে মেজাজ বা অল্পতেই রেগে যাওয়া, অনেক বেশি কথা বলা বা একদম চুপচাপ হয়ে যাওয়া এবং অনেকসময় তার ঘুম, খাওয়া এমনকি যৌন চাহিদারও পরিবর্তন আসতে পারে।
৬. আত্মহত্যার প্রবণতা : যেহেতু মৃগীরোগের সাথে ডিপ্রেশনের সম্পর্ক রয়েছে সেহেতু এই রোগীদের মাঝে প্রায়ই আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। এছাড়াও গবেষণায় মৃগীরোগের সাথে সরাসরিভাবে আত্মহত্যাপ্রবণতার সম্পর্ক পাওয়া গেছে যদিও এর পেছনের কারণ এখনো অজানা।
৭. অতিচঞ্চলতা ও অমনোযোগিতা : সাধারণত মৃগীরোগে আক্রান্ত বাচ্চাদের মাঝে অতিচঞ্চলতা ও অমনোযোগিতা সংক্রান্ত সমস্যা পরিলক্ষিত হয় যর ফলে এই বাচ্চারা পরবর্তিতে লেখাপড়া ও অন্যান্য কাজে অন্য শিশুদের চেয়ে বেশি পিছিয়ে পড়ে।
৮. বুদ্ধির ঘাটতি : দীর্ঘদিন ধরে খিঁচুনির সমস্যা থাকলে এবং চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে বুদ্ধির ঘাটতিজনিত সমস্যা দেখা যায়। বিশেষত, এটি শিশুদের ক্ষেত্রেই বেশি লক্ষণীয়। যেসব শিশুরা একদম ছোটো থেকেই খিঁচুনি রোগে ভুগছে তাদের মাঝে একটা বড়ো অংশকে পরবর্তিতে বুদ্ধিবৃত্তিতে পিছিয়ে পড়তে দেখা যায়। এছাড়া বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতার সাথে মৃগীরোগের একটি উভমুখী সম্পর্ক রয়েছে। দেখা গেছে যে, খিঁচুনি রোগে আক্রান্ত একটা বড়ো অংশের শিশুদের মাঝে পরবর্তিতে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে অন্যদিকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের একটা বড়ো অংশের মাঝেও খিঁচুনি রোগ পাওয়া যাচ্ছে।
৯. স্মৃতিশক্তি হ্রাস : দীর্ঘদিন খিঁচুনি রোগ বিশেষত যেগুলো যথাযথ চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভবত হয়নি কিংবা চিকৎসায় খুব বেশি উন্নতি হয়নি সেসব রোগীদের মাঝে ধীরে ধীরে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেছে।
১০. এন্টিএপিলেপ্টিক ওষুধের প্রভাব : মৃগীরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু এন্টিএপিলেপ্টিক ওষুধের প্রভাবেও অনেকসময় কিছু মানসিক রোগের লক্ষণ দেখা যায়। তাই এসমস্ত ওষুধ সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করা উচিত।
প্যানিক ডিজঅর্ডার চিকিৎসায় ভালো না হওয়ার কারণ ও প্রতিকার
মৃগীরোগ কোনো অভিশাপ বা শয়তানের প্রভাব নয়, এটি মস্তিষ্কের অন্যান্য অসুখের মতোই একটি অসুখ যেটি শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয় পুরো বিশ্বব্যাপী পরিলক্ষিত। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, অন্যদিকে অবহেলায় মৃগীরোগীর জীবন হতে পারে করুণ।
তাই মৃগীরোগ সম্পর্কিত সঠিক ধারণা থাকা খুব জরুরি; বিশেষত, রোগীকে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো সুস্থ, সুন্দর জীবন প্রদান করতে এই রোগ এবং তার সাথে জড়িত মানসিক রোগ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকার বিকল্প নেই।
লেখক : ডা. মাহাবুবা রহমান
এমবিবিএস, এমডি (চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি)
রেজিস্ট্রার, ডিপার্টমেন্ট অব সাইকিয়াট্রি
মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন এন্ড হসপিটাল, ঢাকা৷
সূত্র : মাসিক ‘মনের খবর’ জুলাই ২০২২ সংখ্যা
- মাসিক মনের খবর প্রিন্ট ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতে চাইলে কল করুন : 01797296216 এই নাম্বারে। অথবা মেসেজ করুন পেজের ইনবক্সে। লেখা পাঠাতে পারেন monerkhaboronline@gmail.com বা এই 01844618497 হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে।
/এসএস/মনেরখবর/