আজ শুক্রবার ৩১ মে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয়েছে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি’ শীর্ষক প্রতিপাদ্যে এবারের দিবসটি পালিত হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয় ৪ লাখ মানুষ এবং ১ লাখ ৬০ হাজার জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশের বেশি মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। তামাক ব্যবহারকারীদের ৪৬ শতাংশ পুরুষ ও ২৫ শতাংশ নারী। ধোঁয়াবিহীন তামাক অর্থাৎ জর্দা, গুল ব্যবহার করে ২০ শতাংশের বেশি মানুষ। বিড়ি/সিগারেট খান ১৪ শতাংশের বেশি। একজন ধূমপায়ীর সিগারেটের জন্য প্রতি মাসের গড় ব্যয় প্রায় ১ হাজার ১০০ টাকা। তার পরেও দিন দিন বাড়ছে তামাকের আসক্তির পরিমাণ। অধুমানপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের অন্যান্য রোগসহ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা বেশি।
গবেষণা বলছে, দেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। তামাকের অর্থনৈতিক ক্ষতিও ব্যাপক। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।
যারা ধূমপান করেন তারা প্রায়ই ধূমপান ছাড়তে চান কিন্তু ধূমপান ত্যাগ করা খুবই কঠিন। এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ ধূমপায়ীর ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা আছে। ধূমপান ছাড়ার তেমন কোনো উপায় না থাকলেও গবেষণায় দেখা যায় যে, যারা নিয়মিত সাইকোলজিক্যাল থেরাপি নিয়েছেন তারা ধূমপান ছাড়ার ক্ষেত্রে বেশ সফলতা পেয়েছেন। বিশেষত, যারা অতীতে ধূমপান ত্যাগ করার চেষ্টা করেছেন এবং ছাড়তে অসুবিধা হয়েছে, তাদের সাইকোলজিক্যাল থেরাপি ভালো সহায়তা করতে পারে।
বাংলাদেশে ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ধূমপায়ী টিবি রোগীদের ওপর এক গবেষণা হয়। এতে অংশ নেন ১ হাজার ৫২৭ জন টিবি রোগী। তাদের সবাইকে খুব সংক্ষিপ্ত সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলিং করানো হয়। গবেষণায় অংশ নেওয়া অর্ধেক রোগীকে ধূমপান ছাড়াতে সাহায্যকারী ওষুধ সাইটিসিন দেওয়া হয়। আর অর্ধেককে দেওয়া হয়নি।
দেখা গেছে, এ পরামর্শ যারা গ্রহণ করেছেন, তাদের এক-তৃতীয়াংশ ছয় মাসের মধ্যে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন। যারা ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাদের এক বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, তারা আর সিগারেট ধরেননি।
আমেরিকান বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায়, নিয়মিত সাইকোলজিক্যাল থেরাপি সম্পূন্নরুপে ধূমপান ছাড়তে সহায়তা করে। থেরাপির মাধ্যমে ধূমপানের অভ্যাসের কারণগুলিকে বের করে সাইকোলজিক্যালি সমাধান করা হয়।
তীব্র মানসিক চাপ ধূমপানের তাগিদ তৈরি করে, সাইকোলজিক্যাল থেরাপি সেই চাপ মোকাবিলার পদ্ধতিগুলোর অনুসন্ধান করে, চ্যালেঞ্জিং ও অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে ধূমপানের ইচ্ছাটিকে হ্রাস করতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, যেমন- হতাশা বা উদ্বেগের লক্ষণগুলোর সাথে মোকাবিলা করার জন্য যদি ধূমপান একটি প্রতিরোধের পদ্ধতি হয়, তবে সাইকোলজিক্যাল থেরাপির মাধ্যমে বিকল্প মোকাবিলার পদ্ধতিগুলো বিকশিত হতে পারে। সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার অন্তর্নিহিত কারণের দিকেও মনোযোগ দিতে পারে।
যদি হতাশা, উদ্বেগ বা অন্য কোনো অবস্থার লক্ষণ দেখা যায়, তবে ধূমপানের ইচ্ছা বাড়তে পারে। ধূমপানের জন্য ট্রিগার সম্পর্কে সচেতনতা থেরাপিতে অর্জন করা যেতে পারে এবং বিকল্প আচরণগুলোও অনুসন্ধান করা যেতে পারে, উভয়ই ধূমপানের অভ্যাসটি ভাঙ্গতে সাহায্য করতে পারে।
অনেকগুলো গবেষণায় কগনিটিভ বিহেবিয়ার থেরাপি (সিবিটি) ধূমপান বন্ধে সবচেয়ে বেশি সহায়ক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সিবিটি-তে, নেতিবাচক চিন্তাগুলো পুনর্বিবেচনার পদ্ধতি অনুসন্ধান করা যেতে পারে, যা নিকোটিন অভিলাষ এবং ত্যাগের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো অপ্রীতিকর আবেগ বা অনুভূতির সাথে সাথে প্রত্যাহারের লক্ষণগুলোর সাথেও লডাই করা সহজ করে তুলতে পারে।
সিবিটি চিকিৎসা ধূমপান ত্যাগের ইচ্ছা বাড়াতেও সহায়তা করতে পারে। তবে ধূমপান ছাড়ার ক্ষেত্রে কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি থেকে নিয়মিত কগনিটিভ বিহেবিয়ার থেরাপি নিলে খুব ভালো ফল পাওযা যায়। ব্যাক্তি একটি আবাসিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি থেকে চিকিৎসাকালীন সময়ে নিজের প্রতিদিন জীবন যাপন এবং স্ট্রেসের ফ্যাক্টরগুলো থেকে দূরে থাকে এবং নিয়মিত কগনিটিভ বিহেবিয়ার থেরাপি নেয়, যা তাকে সফলভাবে ধূমপান ছাড়তে সহায়তা করতে পারে।
তবে, শুধুমাত্র ভর্তি রেখে কগনিটিভ বিহেবিয়ার থেরাপি ছাড়া তেমন উপকার পাওয়া যায় না। যাদের আসক্তি খুব বেশি তাদের কিছু মেডিসিনেরও প্রয়োজন হয়।
লেখক : জিয়ানুর কবির
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট।