মানসিক রোগে আক্রান্ত একজন মানুষকে আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি না। কখনও দেখি তিনি নিস্তব্ধ কোনো কবরস্থানে বসে আছেন, আবার কখনও শহরের ভিড়ভাট্টায় নিজেকে মিশিয়ে রেখেছেন। এই দুই বিপরীত আচরণের পেছনে লুকিয়ে আছে ব্রেইনের রাসায়নিক অসামঞ্জস্যতা (Neurochemical Imbalance) এবং মানসিক যন্ত্রণা।
১. নির্জনতার খোঁজ: যখন কোলাহল হয়ে ওঠে যন্ত্রণা
সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) রোগীর ব্রেইনে ডোপামিন (Dopamine) ও সেরোটোনিন (Serotonin) ভারসাম্যহীন থাকে। ফলে মনের ভেতর জন্ম নেয় অকারণ ভয়, সন্দেহ, ভ্রম (Delusion), অদৃশ্য কণ্ঠশব্দ শোনা বা হ্যালুসিনেশন (Hallucination) এবং উদ্বেগ ( Anxiety) । চারপাশের শব্দ, আলো বা মানুষের ভিড় তাদের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে—যাকে বলে সেনসরি অভারলোড (Sensory Overload)। এ থেকে পরিত্রান পেতে তারা আশ্রয় নেন শান্ত, নির্জন পরিবেশ, যেখানে মন ও মস্তিষ্ক সাময়িক প্রশান্তি পায়।
২. কোলাহলের প্রতি টান: নীরবতা যখন অসহনীয়
অন্যদিকে একই মানুষকে কখনও কোলাহল ভিড়ের মধ্যে মত্ত থাকতে দেখা যায়। এর কারণ হলো ব্রেইনের সেই নিউরোক্যামিকেলের অসামঞ্জস্য। এসময় তাদের মনে ভেতর গভীর হয়ে উঠে, হতাশা, শূন্যতা (Emptiness), অনুভূতিহীনতা (Anhedonia) ও একাকিত্ব (Loneliness)। তখন কোলাহল এক ধরনের বাহ্যিক উত্তেজনা বা স্টিমুলেশন (Stimulation) হিসেবে কাজ করে, যা তাদের মনের ভেতরের বিষণ্নতা ঢেকে দেয়। সামাজিক মেলামেশা বা মানুষের উপস্থিতি গান, বাজনা, ফূর্তি তখন সাময়িকভাবে তাদের ভেতরের শূন্যতা (Emptiness) কমাতে সাহায্য করে।
৩. নেশা প্রীতি: সেল্ফ মেডিকেশন এবং সাবটেন্স এব্যুজ (Substance Abuse)
অনেক মানসিক রোগী সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) বাইপোলার ডিসওর্ডার (Bipolar Disorder), বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য যেমন গাঁজা (Cannabis), মদ (Alcohol) বা ইয়াবা (Methamphetamine)-এ ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়েন। গবেষণা মতে মাদকদ্রব্য তাদের উপসর্গগুলোর কিছুটা উপশম ঘটায়। এটাকে বলা হয় সেল্ফ মেডিকেশন (Self-Medication)। তবে ক্রমাগত মাদক ব্যবহারে রোগী আসক্ত হয়ে পড়ে এবং দীর্ঘমেয়াদে এটি বিভ্রান্তি, হ্যালুসিনেশন এবং ভ্রমকে আরও তীব্র করে। ফলে রোগের জটিলতা বেড়ে যায় এবং সঠিক চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত হয়।
৪. এ রহস্যে মুলক আচরণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
এই সকল বৈপরীত্য মূলক আচরণের মুল কারণ হলো ব্রেইনের নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিন ও সেরোটোনিন ওঠানামা (Fluctuation of Neurotransmitters)। একদিকে উদ্দীপনা এড়াতে তারা নির্জনতার বুঁদ হয়ে থাকেন, অন্যদিকে ভেতরের শূন্যতা কাটাতে ভিড়ের মধ্যে চলে যান। এটিই রোগীর ব্রেইনের অসুস্থতার বহি:প্রকাশ।
৫. পরিবার ও সমাজের ভূমিকা
এটি কোনো খামখেয়ালি আচরণ নয়, বরং মনো-দৈহিক-সামাজিক অসুস্থতা (Neuro-psycho-social Disorder)। তাই করণীয় হলো—সহানুভূতিশীল মনোভাব রাখা, নিয়মিত চিকিৎসা ও সাইকোথেরাপি (Psychotherapy) চালানো, কুসংস্কার এড়িয়ে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসায় আস্থা রাখা, সমাজের সকল স্থরে মানসিক রোগ নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা পরিশেষে,
সঠিক চিকিৎসা ও আন্তরিক সহায়তা পেলে সিজোফ্রেনিয়া রোগীরাও (Schizophrenia Patients) স্বাভাবিক ও গতিশীল জীবনে ফিরে আসতে পারেন। তাদের রহস্যময় আচরণের পেছনে কোনো অলৌকিক কারণ নেই, বরং মস্তিষ্কের রাসায়নিক জটিলতা (Neurochemical Complexity) কাজ করে। বোঝার চেষ্টা, সহানুভূতি এবং চিকিৎসার প্রতি আস্থা তাদের জন্য আশার আলো হতে পারে।
ডা. সাঈদ এনাম
সহযোগী অধ্যাপক সাইকিয়াট্রি
ফেলো, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।
সিরিয়ালের জন্য ভিজিট করুন- এপোয়েন্টমেন্ট
আরও দেখুন-