সোশ্যাল মিডিয়া কর্মজীবনে পজেটিভ ও নেগেটিভ প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করছে

0
8
কর্মজীবনে পজেটিভ ও নেগেটিভ প্রতিদ্বন্দ্বিতা

ডা. দেবদুলাল রায়
রেসিডেন্ট, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

বর্তমান বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত। একটি একচুয়াল দুনিয়া বা পার্থিব জগৎ, অপরটি ভার্চুয়াল দুনিয়া। আমাদের শারীরিক অবস্থান এই পার্থিব জগতে আমাদের দৈনন্দিন কাজ, কর্ম, খাওয়া, চলা সবকিছুই পার্থিব জগতে। প্রতিদিনকার কর্মে হাজিরা দেওয়া শারীরিক বা পার্থিব।

কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক জগৎ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। মনের একাংশ দখল করে রেখেছে পার্থিব বা চারপাশের পৃথিবী। অপর অংশ দখল করে রেখেছে ভার্চুয়াল পৃথিবী। পার্থিব পৃথিবীতে কাজে-কর্মে-বন্ধুত্ব- সম্পর্কে যেমন শারীরিকভাবে হাজিরা দেওয়াটা বিধি, তেমনি ভার্চুয়াল জগতেও নিয়মিতভাবে হাজিরা দেওয়া রীতি।

সে হাজিরাতে অবয়ব থাকে না কিন্তু কখনও কখনও সে হাজিরা হয়ে ওঠে অবয়বময় হাজিরার চাইতেও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন উঠতে পারে অস্তিত্ব বা অবয়বহীন এই পৃথিবী কেন মানুষের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। এর কারণ হিসেবে বহু তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে।

কর্মজীবনে পজেটিভ ও নেগেটিভ প্রতিদ্বন্দ্বিতা

কর্মজীবনে পজেটিভ ও নেগেটিভ প্রতিদ্বন্দ্বিতা

কিন্তু অবয়বহীন জগতের এই প্রাধান্য মানুষের বুদ্ধিমত্তার শ্রেষ্ঠত্বের ফসল। একমাত্র মানুষ-ই পারে যা নাই তাতে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস রেখে তাকে যথাযথ প্রয়োগ করতে। বর্তমান পৃথিবীর অনেক ক্যাশলেস ট্রেডের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কারেন্সি এখন অনেক ক্ষেত্রেই একটি সংখ্যামাত্র। কারেন্সি দেখা যায় না, পকেটে ঢুকে না, পকেট থেকে বেরও হয়ে যায় না। কিন্তু অবয়বহীন এই সংখ্যাটিই, তার দ্বারা কাঙ্ক্ষিত সকল কর্ম সূচারুরূপে পালন করে থাকে। অবয়বহীন এই সংখ্যার দ্বারা আমরা খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসাসহ যা যা প্রয়োজন সব কিছু অনায়াসে পেয়ে যাচ্ছি। সেবাদাতাও হাসিমুখে কিছু সংখ্যার বিনিময়ে কাঙ্ক্ষিত সেবাটি প্রদান করে যাচ্ছেন।

আরো উদাহরণস্বরূপ যেকোনো প্রথিতযশা একটি কোম্পানির কথা কল্পনা করা যাক। সেই কোম্পানির হয়ত তিন চারটি কারখানা আর দপ্তর আছে। কিন্তু সেই কোম্পানির অস্তিত্ব দেশের আনাচে কানাচে এমনকি বিদেশেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

কিন্তু দেশের সর্বত্র কিংবা বিদেশে বিস্তর খোঁজাখুঁজি করলেও কিন্তু কোম্পানিটিকে পাওয়া যাবে না, পাওয়া যেতে পারে কোম্পানির পণ্য ও প্রতিনিধি। যদি কোম্পানির সকল পণ্য একযোগে আগুনে ভস্মীভূত করে ফেলা যায় তাতেও কিন্তু কোম্পানি বিলুপ্ত হয়ে যায় না। বরং নতুন পণ্য উৎপাদন করে কোম্পানিটি ঠিকই বাজার দখল করে ফেলে।

আবার মালিক পক্ষের সাথে মতভেদের প্রেক্ষিতে যদি কোম্পানির সকল কর্মচারী পদত্যাগ করে তাতেও কিন্তু কোম্পানিটি বিলুপ্ত হয়ে যায় না। বরং নতুন কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে বহাল তবিয়তে ফিরে আসে। আবার যদি কোম্পানির সকল কারখানা ও দপ্তর পুড়িয়ে ফেলা যায় তাতেও কিন্তু কোম্পানিটি বিলুপ্ত হয় না। বরং ব্যাংক লোন নিয়ে সব কিছু পুনরাস্থাপন করতে পারে।

আবার ব্যাংক ও কারখানা পণ্য, লোকবলবিহীন কোম্পানিটিকে নির্দ্বিধায় লোন দেয়। এর অর্থ উক্ত কোম্পানি বলতে কারখানা, পণ্য কিংবা লোকবল কোনোকিছুকেই বোঝায় না। কোম্পানি একটি ধারণা, একটি অলীক বিশ্বাস কিংবা বুদ্ধিমান মানুষের মারাত্মক কল্পনা, যা না থেকেও আছে, যা না থেকেও মানুষ এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, যা না থেকেও তার অস্তিত্বের চিহ্ন এঁকে দেয় সবখানে। ঠিক তেমনি সোশ্যাল মিডিয়া বুদ্ধিমান মানুষের উন্নতচিন্তার আরেক ফসল। যে জগতের অস্তিত্ব নেই, সেই জগৎকে অস্তিত্বময় জগতের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছে বর্তমান মানুষ।

আর তাই ভার্চুয়াল এই পৃথিবীতে নিয়মিত হাজিরা দেওয়া রীতিমতো ও প্রাত্যহিক নিয়ম ও অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে যাপিত জীবন যেন অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ে, সব থেকেও কিছু না থাকার বেদনায় পুড়তে থাকে মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ডিজিটাল শাট ডাউন তারই সাক্ষ্য বহন করে। ভার্চুয়ালি যুক্ত হতে না পারার বেদনা কমবেশি পুড়িয়েছে সবাইকে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিতি যেহেতু প্রাত্যাহিক নিয়ম তাই ব্যক্তির যা যাবতীয় তথ্য তা সাধারণত সোশ্যাল মিডিয়াতেই শেয়ার করে থাকেন। আবার একই সাথে অনেক মানুষের যুক্ত থাকা যায়, এবং মুহূর্তেই হাজার হাজার মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়া যায় বলে, যেকোনো তথ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়াকেই অধিকতর উপযোগী মনে করে।

ব্যক্তির যেকোনো অর্জন, যেকোনো সাফল্য, যেকোনো সুসংবাদ অন্যদের অবহিত করতে বেছে নেয় সোশ্যাল মিডিয়াকেই। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকলেই চোখে। পরিচিত অপরিচিত মানুষের অর্জন ও সাফল্য গাঁথা। মানুষের একান্ত সুমময়ের চটকদার চিত্রমালা।

সাফল্যের পেছনের ব্যর্থতার ইতিহাস উহ্য থাকে, প্রকাশিত হয় কেবল কাঙ্ক্ষিত অর্জনটুকু। ঠিক তেমনি ভালোবাসাবাসি আর হৃদ্যতার চটকদার ছবিগুলো প্রকাশ পায়। কলহ আর কাদা ছোড়াছোড়ির মুহূর্তগুলো অন্ধকারেই অন্তর্হিত হয়।

এই ছবি অন্যের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অন্য মানুষ যে একই ধরনের সাফল্যের অনুসন্ধানে ব্রতী আছেন, তিনি এই সাফল্যের ছবি দেখে উজ্জীবিত হন। এই বিশ্বাস মনে জন্মায় যে যথাযথ পরিশ্রম করলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। পরিচিতজনের সাফল্য আত্মবিশ্বাসের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। এই আত্মপ্রত্যয়ে প্রত্যয়ী ব্যক্তি দ্ব্যর্থহীন পদক্ষেপে এগিয়ে যান বিজয়ের পথে। একই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার সাফল্যগাঁথা কারও কারও মনে ঈর্ষার সৃষ্টি করে।

নিজের অপ্রাপ্তির জন্য দোষ দিতে শুরু করে ভাগ্য ও পারিপার্শ্বিকতাকে। কেউ কেউ বস্তুগত সুখের প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে পড়েন। যা নিজের নেই, কিন্তু অন্যের আছে তা অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে পড়েন। কাঙ্ক্ষিত সে সব সুখ অর্জন করতে গিয়ে সৎ কিংবা অসৎ কোনো কিছুর ধার ধারেন না। তার কাছে একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় সাফল্য।

তার জন্য শঠতার আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। সোশ্যাল মিডিয়া একটি যোগাযোগ মাধ্যম হলেও আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এর ভূমিকা অনেক গভীর। যেহেতু আমরা জীবনকেই দু-ভাগে ভাগ করে ফেলেছি তাই এই ভার্চুয়াল জীবনকে অস্বীকার করা অনেকটা উট পাখির বালুতে মুখ গুঁজে রাখার মতোই হবে। আবার ক্রমাগত মুক্ত থাকায়, বিভিন্ন জনের বিভিন্ন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার দরুন এর পজেটিভ ও নেগেটিভ উভয় প্রভাবই আমাদের মনোরাজ্যে বিস্তার করবে। আমরা যেকোনো কিছু কীভাবে গ্রহণ করছি তার উপরই মূলত নির্ভর করবে আমাদের জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব।

অ্যাকাডেমিক ফলাফলে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব

  • এপয়েন্টমেন্ট নিতে এখানে ক্লিক করুনঃ APPOINTMENT

আরও পড়ুন:

Previous articleমেডিক্যাল ছাত্র-ছাত্রীদের অ্যাকাডেমিক ফলাফলে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব
Next articleঅনলাইন গেমিং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here