মানসিক সুস্বাস্থ্য বিষয়ে বলার আগে প্রথমে দেখি মন কী? মনের শক্তির উৎস কোথায়? কারণ মনকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মনকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারেননি। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন মন মানুষের সকল শক্তির উৎস। মনের এই শক্তি রহস্যকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারলেই এই শক্তিকে আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারব। মানুষের শক্তির আসল উৎস দেহ নয়, চেতনা। দেহ হচ্ছে চেতনার বসবাস। আর মনের শক্তি এই চেতনারই একটা রূপমাত্র।
মনকে সুস্থ রাখতে পারলে সাফল্যের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে থাকবে। অর্থাৎ মানসিক সুস্থতা তো সকল কিছুরই উৎস। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বা লক্ষ্য দ্বারাই মন নিয়ন্ত্রিত, আর মস্তিষ্ক পরিচালিত হয়। দৃষ্টিভঙ্গি আবার দু’ধরনের। ইতিবাচক ও নেতিবাচক। আত্মবিকাশী বা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই মানসিক সুস্থতা। আবার আত্মবিনাশী বা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই মানসিক অসুস্থতা। অবিশ্বাস্য হলেও আমাদের অধিকাংশ মানুষের চিন্তা জগতের শতকরা ৭০-৮০ ভাগই দখল করে রাখে রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, দুঃখ, অনুতাপ, অনুশোচনা, কুচিন্তা, বিষন্নতা, হতাশা ও নেতিবাচক চিন্তারূপী আত্মবিনাশী ভাবনা।
এসব থেকেই মানুষ ক্রমান্বয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবার আমরা যদি এই প্রক্রিয়াকে উল্টে দিতে পারি অর্থাৎ ৭০-৮০ শতাংশ চিন্তাকেই আত্মবিকাশী বা ইতিবাচক চিন্তায় পরিণত করতে পারি তাহলেই মানসিক সুস্থতা আসবে। বিজ্ঞানীরা বলেন মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজন নিজের সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ নিজের মনের চালক বা দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। ইতিবাচক চিন্তাকে ৭০ ভাগে উন্নীত করতে পারলে নেতিবাচক চিন্তা ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাবে।
প্রবাদ আছে, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়ো। মানুষ নিজেকে যা ভাবতে পারে, একসময় তাই করতে পারে। আত্মবিকাশী চিন্তা, ইতিবাচক চিন্তা প্রয়োজন মানসিক ভালো থাকা, সফলতার জন্য, সুন্দর সুখী জীবনের জন্য। সুস্বাস্থ্যই জীবন। আর সুস্বাস্থ্য মানেই মানসিক, শারীরিক, আত্মিক সুস্থতা। আগেই বলেছি, মানসিক সুস্থতার ভিত্তি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি, লক্ষ্য বা অভিপ্রায়। মন পরিচালিত হয় দৃষ্টিভঙ্গি, লক্ষ্য বা অভিপ্রায় দিয়েই। আর মস্তিষ্ককে চালায় মন। বিজ্ঞানীরা বলেন, একজন প্রোগ্রামার যেভাবে কম্পিউটারকে পরিচালিত করে, তেমনি মন মস্তিষ্ককে পরিচালিত করে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আমরা একেবারেই অসচেতন। আমরা লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে শরীরের যত্ন নেই, চিকিৎসা করি কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে থাকি একেবারেই উদাসীন। মানসিক সুস্থতা বা মানসিক শক্তি দিয়ে মানুষ দৈহিক পঙ্গুত্বকেও উপহাস করতে পারে। তার অনেক প্রমাণ আছে। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং লিখতে বা কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু বিশেষ কম্পিউটারের সাহায্যে বিজ্ঞান জগতের আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ রচনা করেছেন।
মানুষের অসীম শক্তি ও সম্ভাবনাকে সবসময় শৃঙ্খলিত ও পঙ্গু করে রাখে সংস্কার ও ভ্রান্ত বিলাস ও নেতিবাচক ভাবনা। অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিমলে প্রচলিত ধারণার শৃঙ্খলে সে ক্রমান্বয়ে বন্দী হয়ে পড়ে।
পরিবেশ যা তাকে ভাবতে শেখায় সে তাই ভাবে, যা করতে বলে তাই করে। সমাজের ভ্রান্ত বিলাস নেতিবাচক চিন্তা, কুসংস্কার ত্যাগ করা সহজ নয়। হাজার বছরের কুসংস্কার আমাদের জীবনের গহীনে গেঁথে গেছে। কখনো কখনো এসব ভাবনাকে, নেতিবাচক চিন্তাকে আমরা নিয়তি হিসেবে নিয়ে থাকি। বিজ্ঞান বা ধর্মের প্রবল বিশ্বাসের কথা বলে থাকলেও জীবনে অনুসরণ করি অবৈজ্ঞানিক বা কু-ধর্মীয় চিন্তাধারা।
মানসিক রোগ ও সাধারণ রোগের চিকিৎসা নিয়ে প্রচলিত কুসংস্কার থেকে সহজে বেরিয়ে আসার তেমন কোনো সহজ পথ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এখানে একটা উদাহরণ দেই-আমরা যেকোনো ধরনের হৃদরোগীদের প্রচলিত চিকিৎসা দিয়ে থাকি এনজিও প্লাস্টি বা বাইপাস বা প্রচলিত ওষুধ। আমরা জানি হৃদরোগ শুধু খাওয়া, খারাপ অভ্যাসের কারণে হয় না বরং মানসিক চাপ বা টেনশন থেকেও হতে পারে। এখন একজন স্ত্রীর সাথে মানসিক বিরোধ বা ঝগড়ার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। প্রচলিত চিকিৎসা করে সাময়িক সুস্থ্ হলেন, কিন্তু আবারও ঘরে ফিরে সে বিরোধ শুরু হলো। এখন এটাকে কী বলবেন? অর্থাৎ মানসিক বা শারীরিক চিকিৎসা দিতে হবে সবকিছু বুঝে বিশ্লেষণ করে। কিন্তু আমাদের দেশের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত।
মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বকে সর্বসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে আরও গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা দরকার। অধ্যাপক এম. ইউ আহমেদের ন্যায় মনোচিকিৎসকদের উদ্যোগ দরকার। যাদের গবেষণা, লেখালেখি, কথাকে রাষ্ট্র গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে। অর্থাৎ মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতা প্রচলিত ওষুধে হবে না। মনের চিকিৎসা বা মনের নিয়ন্ত্রণ করতে পারাই মানসিক চিকিৎসা এটা সর্বসাধারণকেও বোঝাতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য ও দৈহিক স্বাস্থ্য যে ভিন্ন বিষয় এ বিষয়ে গণমাধ্যম জানলেও সেটা তেমন পরিলক্ষিত হয় না। অর্থাৎ প্রচলিতভাবে সবার ন্যায় গণমাধ্যমও একইভাবে ঢালাও বিবেচনা করে থাকে। সেটা প্রতিদিনের সংবাদ বা প্রকাশিত ফিচার দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের অধিকাংশ সংবাদপত্র বা টেলিভিশন, অনলাইনে স্বাস্থ্যপাতা বা বিভাগ থাকলে সেখানে প্রকাশিত অধিকাংশ লেখাই দেহ রোগের চিকিৎসা নিয়ে। খুব অল্প কয়েকটি লেখা দেখবেন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে। আমরা শুধু গণমাধ্যমের কথা বলছি কেন, অধিকাংশ চিকিৎসকেরাও মানসিক স্বাস্থ্যকে তেমন আমলে নেন না।
মানসিক চিকিৎসার সুযোগ বাড়ানো বা গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে। আমরা এখন অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হচ্ছি। আমাদের দেশে জনশক্তির বোনাসকাল (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট) চলছে।
সাইফ ইসলাম দিলাল
ডেপুটি হেড অব নিউজ, একুশে টেলিভিশন,
সাবেক সভাপতি, ইকনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম-ইআরএফ।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৯ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে